শুনশান মহাসরণী । শুষ্ক হাওয়ার সাথে খবরের কাগজের ছেড়া পাতার একটা অংশ রাস্তার এপাশ হতে ওপাশে উড়ে যায়। সেই হাওয়ার জোড়ে রং জ্বলে যাওয়া সোডার একটি ক্যান পিচঢালা সড়কের বুক চিড়ে বাধাহীন গড়িয়ে চলে। চারিদিকে নৈঃশব্দ্য। কাছে-দূরে কোথাও কোন ব্যস্ততার চিহ্ন নেই। সময় গড়িয়ে চলেছে আপন মনে। কুমারি লতা, কুঞ্জলতা লতা, অলকানন্দা, অনন্তমূল, ঘোড়া গুলঞ্চ, পদ্ম গুলঞ্চসহ নানা লতাগুল্ম ভয়-শঙ্কাহীন চিত্তে ফুটপাত জুড়ে তরতর করে বেড়ে উঠছে। নগরের সবচেয়ে ব্যস্ততম চত্ত্বরের পাশেই অতিকায় শপিংমলের সামনে একদল কুকুর ঘুমিয়ে আছে। কদাচিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। ক্যান গড়িয়ে আসার মৃদু শব্দে অপেক্ষাকৃত তরুন কুকুরটি তন্দ্রা ভেঙ্গে চোখ খুলে। ভ্রু কুচকে মুখটি গুজে রেখেই বুঝার চেষ্টা করছে, এটা কিসের শব্দ। ধীরে ধীরে শব্দটা তীব্র হতে থাকে। দলের বুড়ো কুকুরগুলো সেই শব্দটাকে পাত্তা দেয় না। তরুন কুকুরটি আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। কিছুটা আলসেমী আর ভাবলেশহীনভাবে পা বাড়ায়। শপিংমলের সান বাধানো দামী পাথরের চত্ত্বর ছেড়ে এগিয়ে যায় রাস্তার দিকে। ডানে-বামে যতদূর চোখ যায় কোন কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। ঘাড় নুয়ে গড়গড় শব্দ করে ফিরে আসার আগে শেষবারের মতো আরও একবার রাস্তার দিকে চোখ রাখে। দূরে কিছু একটা নজর কাড়ে তার। পরক্ষনেই সর্তকদৃষ্টি নিয়ে বুকটান করে দাঁড়িয়ে যায় কুকুরটি। দলের অন্য কুকুরগুলোও বুঝে গেছে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। সকলেই দ্রুত হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। উৎসুক চোখ দূরের জিনিসটা কি হতে পারে তা বুঝার চেষ্টা করছে। রৌদ্র ঝলমলে দিনে পিচঢালা সড়কের মাঝ বরাবর দূরে কালো বিন্দুর মতো কিছু একটা এগিয়ে আসছে। কুকুরগুলো আরও সর্তক হয়ে উঠে। দলের সবচেয়ে বলশালী কুকুরটি কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যায়। দূরের মরীচিকা ভেদ করে কালো বিন্দুটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। কালো বিন্দুর মতো বস্তুটি এখন স্পষ্ট। কুকুরগুলো বুঝে গেছে-সে আগুন্তুক। নিরাপদ দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে যায় কালো বিন্দুটি। এখন বুঝা যাচ্ছে এটি আসলে একটি শিয়াল। বিপদের আঁচ বুঝতে পেরে শিয়ালটিও সর্তক দৃষ্টি দিয়ে কুকুরগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। দু’পক্ষই মুখোমুখি। কোন এক অদৃশ্য সময়ের অপেক্ষায় কুকুরগুলো। চারিদিক নিস্তব্ধ। কেবলি বাতাসের শিষ ধ্বনি মাঝে মাঝে সুর তুলছে আপনমনেই। সোডার রং জ্বলে যাওয়া ক্যানটা বাতাসের সেই সুরের সাথে অদ্ভুতভাবে যুগলবন্দী ধুন তৈরি করে এগিয়ে চলেছে। বাতাসের খেলা শেষ হলে ক্যানটাও বিরতি নেয়। সমস্ত নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে কুকুরগুলো ধারালো দাঁত বের করে আওয়াজ তুলে ছুটে আসতে থাকে শিয়ালটার দিকে। শিয়ালটার হাতে সময় কম। বিপদের গন্ধ টের পেয়েই সে ছুটতে থাকে। সড়ক ছেড়ে পাশের ভবনগুলোর ফাঁকগলে ক্ষীপ্র গতিতে ছুটতে থাকে। কুকুরগুলোও পিছু নেয়। ছুটতে ছুটতে শিয়ালটি এসে পড়ে সরু একটি গলিতে। সেটা ধরেই ছুটতে থাকে। এ-গলি ও-গলি হয়ে এসে দাঁড়ায় নগরের ছোট্ট উদ্যানটির সামনে। উদ্যানের অনুচ্চ দেয়ালের ভাঙা অংশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে পুরো উদ্যান। সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়াসহ নানান গাছগুলো আয়েশিভাবে দাঁড়িয়ে। নেই কোন হর্ণের শব্দ, নেই কোন ধুলির আস্তরণ। কেবলি সবুজ আর সবুজ। সেই সাথে বর্ণিল সব পুষ্পের মায়াবি হাসিতে এক টুকরো স্বর্গ তৈরি হয়েছে। সবুজের সেই স্বর্গে বেশ কিছু কাঠ ময়ূর, মথুরা নির্বিঘ্নে পায়চারি করছে। একদল জংলী কবুতর আর ঘুঘু ঘাসের ফাঁকে আহার খুটে খুটে খেতে ব্যস্ত। শিয়ালটি ঘাসের ফাঁকে বসে পড়ে। শিকার করার ইচ্ছাটা তার দমে যায়। সে অপেক্ষা করতে থাকে সূর্যাস্তের। রাতের শহরে সে বেশ দাপটেই চলতে পারে।
নগরের সবচাইতে উঁচু দালানের আড়ালে ঝকঝকে রূপালি চাঁদের আনাগোনা। আজ শুক্লা একাদশী। জোছনায় পুরো নগর লন্ঠনের মতো মিষ্টি আলোয় আলোকিত। নগরের বিদ্যুৎবাতীগুলো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। পরিত্যক্ত সেল ফোনের টাওয়ার হতে হুতুম পেঁচা পাখা মেলে উড়ে যায় খাদ্যের সন্ধানে। পেঁচাটি উড়ে এসে বসে জলহীন ওয়াটার হাইড্রেন্টে। তিক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে নজর রাখে শিকারের উপর। বেশ ক’টি ইঁদুর ভবনগুলোর আধখুলা দরজার নিচ হতে বের হয়ে আসে। মানুষের ফেলে যাওয়া বিলাসবহুল গাড়ীটার নিচ দিয়ে সর্তক দৃষ্টি নিয়ে দেখে নেয় চারপাশ। তারপর গুটিগুটি পায়ে দৌড়। সড়কের পাশ ধরে সারিবদ্ধভাবে ছুটে চলে। সকলের ভাগ্য হয়তো প্রসন্ন নয়। তাদের ভিতর কেউ একজন আজ শিকার হতে চলেছে। প্রকৃতির অমুঘ নিয়মে।
অনেক দিন হল নগরটা পরিত্যক্ত। শুধু এ নগরই নয়। একে একে জনশূন্য হয়ে গেছে অনেক নগর। মানুষেরা যেনো এক নিমিষেই উধাও। অদৃশ্য এক শত্রুর সাথে মোকাবিলায় পেরে উঠতে পারেনি এই সভ্যতা। প্রথমে নগর ছেড়েছে তারপর গ্রাম। তারপর ধরণী ছাড়তে হয়েছে অধিকাংশের। গুটি কয়েক মানুষ এখনও টিকে আছে, তারাও বিছিন্ন। কেউ বলতে পারে না, কে কোথায়? কি ভাবে আছে?
গল্পটা এখানেই থামাতে হলো…। আমরা এমন জনপদ চাই না। চাই না সেই বিষাক্ত নগর সভ্যতাও। চাই না অরণ্য ধ্বংস করে অশুভ শিল্পায়ন। চাই না বন্য প্রাণীগুলো হয়ে উঠুক আমাদের ডাইনিংয়ের বিলাসী আহার। কিছু মহামারী বদলে দিয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাস । তবু আমরা সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারি না। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে মহামারীগুলো আমাদের থমকে দিয়ে ছিল সেই সব মহামারীর মহা গল্প নিয়ে এই লিখার আয়োজন।
মানবজাতির শিকার-সংগ্রহের দিনগুলিতেও সংক্রামক ব্যাধির উপস্থিতি ছিল। তবে ১০,০০০ বছর আগে কৃষির বিপ্লব ঘটলে শুরু হয় কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। আর এই কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই ক্রমে ক্রমে গড়ে তুলে নগর সভ্যতা। তখন থেকেই মহামারী ব্যাপক আকারে দেখা দিতে থাকে। কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রাথমিক যুগ থেকেই ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠরোগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, বসন্ত ইত্যাদি রোগ মহামারী আকারে প্রথম দেখা দেয়।
মানবজাতির শিকার-সংগ্রহের দিনগুলিতেও সংক্রামক ব্যাধির উপস্থিতি ছিল। তবে ১০,০০০ বছর আগে কৃষির বিপ্লব ঘটলে শুরু হয় কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। আর এই কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই ক্রমে ক্রমে গড়ে তুলে নগর সভ্যতা। তখন থেকেই মহামারী ব্যাপক আকারে দেখা দিতে থাকে। কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার প্রাথমিক যুগ থেকেই ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠরোগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, বসন্ত ইত্যাদি রোগ মহামারী আকারে প্রথম দেখা দেয়।
মানব সভ্যতার যতই বিকাশ ঘটতে থাকে নগরের বিস্তৃতি ততই ঘটতে থাকে। সেই সাথে শুরু হয় এক নগরের সাথে অন্য নগরের বাণিজ্য। যা এক সময় নগর ও অঞ্চলের সীমা ছাড়িয়ে বিশাল পরিসরে রাষ্ট্র কেন্দিক হয়ে ওঠে। মানুষ তার বাণিজ্যের সুবিধার জন্য তৈরি করে রাস্তা-ঘাট। শুরু হয় জাতিতে জাতিতে অবাধ যাতায়াত ও যোগাযোগ। সংস্কৃতির যেমন কোন সীমানা থাকে না তেমনি রোগ বালাইও কোন সীমানা মানে না। নগরের জনবহুল জীবনে পরিবেশ ও প্রতিবেশ দূষণের মাত্রাও বেশি। সংক্রামক ব্যাধিগুলো দ্রুত ছড়ায়। কখনও কখনও তার ব্যাপ্তি হয় কোন মহাদেশ জুড়ে, কখনও পুরো বিশ্বে। মানব ইতিহাসের বাক বদলে দেয়া কিছু মহামারীর বিবরণ উপস্থান করা যেতে পারে।
৪৩০ খ্রিস্টপূর্ব : অ্যাথেনস
নথিপত্রে পাওয়া প্রথম মহামারীটির শুরু হয় পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের (Peloponnesian War) সময়। এই রোগটি লিবিয়া, ইথিওপিয়া এবং মিশরের অধিবাসীদের আক্রান্ত করে এবং স্পার্টানদের অবরোধ করে রাখা অ্যাথেনিয়ার দেয়াল অতিক্রম করে অ্যাথেনসে ছড়িয়ে পরে। জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়।
এই রোগের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, তৃষ্ণা, রক্তাক্ত গলা ও জিহ্বা, লাল ত্বক এবং ক্ষত। টাইফয়েড জ্বর বলে সন্দেহ করা এই রোগটি অ্যাথেনিয়ানদের উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করেছিল এবং স্পার্টানদের কাছে তাদের পরাজয়ের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল।
১৬৫ খ্রিস্টাব্দ: অ্যান্টোনিন প্লেগ (Antonine Plague)
অ্যান্টোনিন প্লেগে সম্ভবত হানসরা প্রথম আক্রান্ত হয়। যা সম্ভবত গুটি বসন্তের প্রাথমিক প্রাদুর্ভাব। হানসদের কাছ থেকে তা জার্মানদের মাঝে ছড়ায়। জার্মান ফেরত রোমান সৈন্যরা এই রোগটি নিয়ে আসেন রোম সাম্রাজ্যে। ১৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোগটির মারাত্মক প্রভাব থাকে। এই রোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্য বরণ করেন রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস।
২৫০ খ্রিস্টাব্দ: সাইপ্রিয়ান প্লেগ (Cyprian Plague)
প্রাপ্ত তথ্যমতে এই রোগের প্রথম শিকারে পরিণত হন কার্থেজের খ্রিস্টান বিশপ। সাইপ্রিয়ান প্লেগ ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, গলার আলসার, জ্বর এবং হাত ও পায়ে মম্পীড়িত বা পচনশীল ক্ষতের সৃষ্টি (gangrenous) হয়।
শহরবাসী সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু এতে করে তারা রোগটি আরও ছড়িয়ে দেয়। সম্ভবত ইথিওপিয়ায় শুরু হয়ে এটি উত্তর আফ্রিকা হয়ে রোমে পরে মিশরে এবং আরও উত্তর দিকে ছড়িয়ে পরে। তিন শতাব্দী পর এটির পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। ৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে এটি ব্রিটেনকে আঘাত করেছিল এবং পিকস এবং স্কটসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্থ করেছিল, যার ফলে ব্রিটিশরা স্যাকসনদের সাহায্য চাইতে শুরু করেছিল। যারা পরবর্তীতে দ্বীপটি নিয়ন্ত্রণ করে।
৫৪১ খ্রিস্টাব্দ: জাস্টিনিয়ান প্লেগ (Justinian Plague)
জাস্টিনিয়ান প্লেগ প্রথমে মিশরে তারপর ফিলিস্তিন, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং ধীরে ধীরে ভূমধ্যসাগর অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মহামারীটি সাম্রাজ্যের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। রোমান সাম্রাজ্যকে আবার একত্রিত করার জন্য সম্রাট জাস্টিনিয়ানদের পরিকল্পনাগুলি দমন করে দেয় এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটের কারণ ঘটায়। এটি এমন একটি রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে যা খ্রিস্টধর্মের দ্রুত প্রসারকেও উত্সাহিত করার জন্য কৃতিত্বপ্রাপ্ত।
পরবর্তী দুটি শতাব্দীতে এই রোগটির পুনরাবৃত্তির ফলে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। যা ছিল বিশ্বের জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ। এটি বুবোনিক প্লেগের (bubonic plague) প্রথম উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি হিসাবে ধারণা করা হয়, যার জীবাণু ইঁদুর বহন করে এবং মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
একাদশ শতাব্দী: কুষ্ঠরোগ (Leprosy)
যদিও এটি প্রায় যুগেই ছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে কুষ্ঠরোগ মহামারী আকারে বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং এর ফলে বিপুল সংখ্যক ক্ষতিগ্রস্থ লোকদের থাকার জন্য অসংখ্য কুষ্ঠ-কেন্দ্রিক হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল।
কুষ্ট ধীরে ধীরে বিকাশকারী ব্যাকটিরিয়া জনিত রোগ। যা শরীরে ঘা এবং বিকৃতি ঘটায়। তখন কুষ্ঠরোগ ঈশ্বরের পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে বিশ্বাস করা হতো। এই বিশ্বাসের উপর ভর করে ভুক্তভোগীদের নির্মূল করা হয়। এখন হানসেনের রোগ হিসাবে পরিচিত। এটি এখনও বছরে কয়েক হাজার মানুষকে আক্রান্ত করে এবং অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিত্সা না করা হলে মারাত্মক হতে পারে।
১৩৫০: দ্য ব্ল্যাক ডেথ (The Black Death)
বিশ্ব জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যুর জন্য দায়ী বুবোনিক প্লেগের এই দ্বিতীয় উপস্থিতি সম্ভবত এশিয়াতে শুরু হয়েছিল । বাণিজ্য কাফেলাগুলির মাধ্যমে পশ্চিমে ছড়িয়ে পরে ছিল। ১৩৪৭ সালে রোগটি সিসিলিতে প্রবেশ করে। যখন প্লেগ আক্রান্তরা মেসিনা বন্দরে এসে পৌঁছায় তখন তা দ্রুত ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মৃতদেহগুলির এতটাই বাজে অবস্থা ছিল তা মাটিতে পচা থেকে যায় এবং নগরগুলিতে মারাত্মক দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে।
ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স এই মহামারীর জন্য যুদ্ধবিরতি করেছিল। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির জন্য ব্রিটিশ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। গ্রিনল্যান্ডের লুটপাট করা জনগোষ্ঠী ও ভাইকিংসরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর শক্তি হারিয়েছিল এবং উত্তর আমেরিকায় তাদের অনুসন্ধান বন্ধ করে দিয়েছিল।
১৪৯২: কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ (The Columbian Exchange)
ক্যারিবীয় অঞ্চলে স্প্যানিশদের আগমনের ফলে গুটি বসন্ত, হাম ও বুবোনিক প্লেগের মতো রোগগুলি ইউরোপীয়রা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই রোগগুলি আদিবাসীদের ধ্বংস করেছিল এবং উত্তর ও দক্ষিণ মহাদেশে প্রায় ৯০ শতাংশ লোক মারা যায়।
হিস্পানিওলা দ্বীপে পৌঁছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মুখোমুখি হয়েছিল টাইনো আদিবাসীর লোক, তখন জনসংখ্যা ছিল ৬০,০০০ জন। ১৫৪৮ সালের মধ্যে এই জনসংখ্যা ৫০০ জনেরও কম হয়ে যায়।
১৫২০ সালে অ্যাজটেক সাম্রাজ্য আফ্রিকান দাসদের মাধ্যমে আসা গুটি বসন্তের সংক্রমণের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়।
১৬৬৫: লন্ডনের প্লেগ (The Great Plague of London)
বুবোনিক প্লেগের দ্বিতীয় আর্বিভাব লন্ডনের জনসংখ্যার ২০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। মানুষের মৃত্যুর পরিমাণ এত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল যে তাদের গণকবর দিতে হয়েছিল। কুকুর বিড়াল যাতে লাশের ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য লক্ষ লক্ষ বিড়াল এবং কুকুরকে হত্যা করা হয়েছিল । মহামারীর ফলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার তৈরি হয় ১৬৬৬ সালে। কারণ একই সময়ে অন্য আরেকটি বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটে যা ইতিহাসে ‘লন্ডনের গ্রেট ফায়ার’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৮১৭: প্রথম কলেরা মহামারী (First Cholera Pandemic)
পরবর্তী দেড়শ বছর ধরে সাতটি কলেরা মহামারীর মধ্যে প্রথমটি হয়েছিল রাশিয়াতে, যেখানে এক মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। মল দ্বারা সংক্রামিত জল এবং খাবারের মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাকটিরিয়া বাহিত এই রোগটি ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে ভারতে আসে এবং লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যুর কারণ হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং ব্রিটিশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে কলেরা স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে কলেরার জন্য প্রায় দেড় লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। ১৮৮৫ সালে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছিল, তবে মহামারীটি অব্যাহত ছিল।
১৮৫৫: তৃতীয় প্লেগ মহামারী (The Third Plague Pandemic)
তৃতীয় প্লেগ মহামারী চীন থেকে শুরু করে ভারত এবং হংকংয়ে পাড়ি জমায়। প্রায় ১৫ মিলিয়ন মানুষ এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। প্রথমে এটি মাছির মাধ্যমে ইউনান-এ খনির খনন চলাকালীন এক বিস্ফোরণের দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে। প্লেগ পার্থ বিদ্রোহ এবং তাইপিং বিদ্রোহের একটি কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে সবচেয়ে প্রাণহানী ঘটায় মহামারীটি। মহামারীর অজুহাতে ব্রিটিশরা ব্যাপক দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেছিল যা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কিছু বিদ্রোহের সূচনা করে। মহামারীটি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সক্রিয় হিসাবে বিবেচিত হত ।
১৮৫৭: ফিজি হামের মহামারী (Fiji Measles Pandemic)
ফিজি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়ার পরে, একটি রাজকীয় দল রানী ভিক্টোরিয়ার উপহার হিসাবে অস্ট্রেলিয়া সফর করেছিল। হামের প্রকোপ চলাকালীন রাজকীয় দলটি তাদের দ্বীপে এই রোগটি ফিরিয়ে এনেছিল এবং উপজাতি প্রধানরা ও পুলিশের মাধ্যমে রোগটি ফিজিতে আরও ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ রাজকীয় দলটি বিদায় বেলায় উপজাতি প্রধান ও পুলিশের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল।
রোগটি এতটাই দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে, দ্বীপটি মৃতদেহের জঞ্জালে পরিণত হয়। বন্য প্রাণী সেই দেহগুলো ভক্ষণ করে যার ফলে পুরো দ্বীপে তা ছড়িয়ে পরে। গ্রামগুলো আক্রান্ত হয়েছিল ও অধিবাসীরা মারা গিয়েছিল এবং তাদের আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হতো। কখনও কখনও আক্রান্ত জীবিতদেরও সেই আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছিল। ফিজির জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ প্রায় ৪০,০০০ লোক মারা গিয়েছিল।
১৮৮০: রাশিয়ান ফ্লু (Russian Flu)
প্রথম উল্লেখযোগ্য ফ্লু মহামারী সাইবেরিয়া এবং কাজাখস্তানে শুরু হয়েছিল, যা মস্কো, ফিনল্যান্ড এবং তারপরে পোল্যান্ডে পাড়ি জমায়, যেখান থেকে এটি ইউরোপের বাকী অংশে চলে যায়। পরের বছর নাগাদ এটি মহাসাগর পেরিয়ে উত্তর আমেরিকা এবং আফ্রিকাতে প্রবেশ করেছিল। ১৮৯০ এর শেষদিকে, ৩,৬০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল।
১৯১৮: স্প্যানিশ ফ্লু (Spanish Flu)
বিশ্বজুড়ে ৫০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল এভিয়ান বাহিত ফ্লুতে। তাত্ক্ষণিকভাবে স্পেনীয় ফ্লু চীন থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এবং চীনা শ্রমিকরা ইউরোপে যাওয়ার পথে কানাডার জুড়ে রেলপথে পরিবহণ করছিল। উত্তর আমেরিকাতে ফ্লুটি প্রথম কানসাসে ১৯১৮ সালের প্রথম দিকে দেখা দেয় এবং বসন্তের মধ্যে ইউরোপে দৃশ্যমান হয়। ১৯১৮ সালের বসন্তে মাদ্রিদে ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের ওয়্যার সার্ভিস রিপোর্টের ফলে মহামারীটি ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে পরিচিত পায়।
অক্টোবরের মধ্যে কয়েক হাজার আমেরিকান মারা গিয়েছিল । তবে ফ্লু হুমকি ১৯১৯ এর গ্রীষ্মে অদৃশ্য হয়ে যায় যখন আক্রান্তদের বেশিরভাগই রোগ থেকে মুক্তি বা মারা গিয়েছিল।
১৯৫৭: এশিয়ান ফ্লু (Asian flu)
হংকং থেকে শুরু করে পুরো চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এশিয়ান ফ্লু ইংল্যান্ডে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল যেখানে ছয় মাসের মধ্যে ১৪,০০০ লোক মারা গিয়েছিল। ১৯৫৮ সালের গোড়ার দিকে দ্বিতীয় দফায় আবার রোগটি দেখা দেয়। কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১১৬,০০০ মানুষের মৃত্যু নিয়ে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক মোট ১.১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কার্যকরভাবে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছিল যার ফলে মহামারীটি দমন করা যায়।
১৯৮১: এইচআইভি / এইডস (HIV/AIDS)
১৯৮১ সালে প্রথম চিহ্নিত হয়। এইডস একটি ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়, ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
আমেরিকান সমকামী সম্প্রদায়গুলিতে এইডস প্রথম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল তবে ১৯২০ সালে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আসা শিম্পাঞ্জি ভাইরাস থেকে আক্রান্ত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। শরীরের নির্দিষ্ট তরলগুলির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই রোগটি ১৯৬০ এর দশকে হাইতি এবং তারপরে নিউ ইয়র্ক এবং ১৯৭০ সালের দিকে সান ফ্রান্সিসকোতে ছড়িয়ে পড়ে।
এই রোগের অগ্রগতি মন্থর করার জন্য চিকিত্সা পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে, তবে বিশ্বব্যাপী ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এইডস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে এবং এর প্রতিকার এখনও পাওয়া যায়নি।
২০০৩: সার্স (SARS)
২০০৩ সালে চিহ্নিত করা হয়। যদিও বেশ কয়েক মাস ধরে এই রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিল। শ্বাসযন্ত্রের কিছু তীব্র লক্ষণ সম্পন্ন রোগটি সম্ভবত বাদুড় থেকে সংক্রমিত হয়ে বিড়ালদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারপরে চীনে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল এরপরে আরও ২৬টি দেশে ৮০৯৬ মানুষ সংক্রামিত হয়েছিল এবং ৭৭৪ জন মারা গেছে।
শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা, শুকনো কাশি, জ্বর এবং মাথা এবং শরীরের ব্যথা দ্বারা চিহ্নিত এবং কাশি এবং হাঁচি থেকে শ্বাস প্রশ্বাসের ফোঁটা দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে।
কোয়ারান্টাইন প্রচেষ্টা কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল । ঐ বছরের জুলাইয়ের পর ভাইরাসটি আর দেখা যায়নি। প্রাদুর্ভাবের শুরুতে ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য দমন করার চেষ্টা করার জন্য চীন সমালোচিত হয়েছিল।
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য পেশাদাররা সার্সকে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করার সংকেত হিসাবে দেখেছিল এবং এই মহামারী থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলি এইচ১এন১(H1N1), ইবোলা এবং জিকার মতো রোগগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
2019: COVID-19
২০২০ সালের ১১ ই মার্চ পর্যন্ত ১১৪ টি দেশের ১১৮,০০০ এরও বেশি লোককে সংক্রামিত করার পরে COVID-19 ভাইরাসটি আনুষ্ঠানিকভাবে মহামারী হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করে।
COVID-19 নোভেল করোনাভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট। লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্ট, জ্বর এবং কাশি এবং নিউমোনিয়ার মতো কিছু লক্ষণ। ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ করা ও ব্যবহৃত জিনিস পত্র থেকেও এই ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে।
১৭ নভেম্বর, ২০১৮ এ চিনের হুবাই প্রদেশে প্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণ দেখা দেয়। কিন্তু তখন পর্যন্তও ভাইরাসটি সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ডিসেম্বর মাস নাগাদ আরও আটটি ঘটনায় গবেষকরা একটি অজানা ভাইরাসের প্রতি ইঙ্গিত করেন।
COVID-19 সম্পর্কে প্রথম জানতে পেরেছিলেন চিনের একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ লি ওয়েইনলিয়াং। তিনি সরকারী আদেশকে অমান্য করে অন্যান্য চিকিত্সকদের কাছে ভাইরাস সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। পরের দিন, চীন ডব্লিউএইচওকে বিষয়টা জানায় এবং লি’র বিরুদ্ধে একটি অপরাধের অভিযোগ আনে। লি এক মাস পরে কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
১১ ই ফেব্রুয়ারি, সংক্রমণটি আনুষ্ঠানিকভাবে COVID-19 নামকরণ করা হয়।
বলা যায় আজ বিশ্ব একটি অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে হবেই। তবে করোনা ভাইরাসের জন্য প্রকৃতি পেয়েছে কিছুটা নিস্তার। ফিরতে শুরু করেছে তার স্বরূপে। সমগ্র বিশ্ববাসী যেভাবে এই অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ঠিক তেমনি আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর অরণ্য ধ্বংস নয়। আর বন্য প্রাণীদের আবাস নষ্ট নয়। নগরগুলোও হয়ে উঠুক সবুজ। কেননা আমরা চাই, ‘সমৃদ্ধ সবুজ পৃথিবী’।
তথ্যসূত্র: মহামারির বিবরণগুলো হিসট্রি ডট কম হতে গৃহীত।
ফিচার ছবি: আন্তজাল