টিভি খুলতেই শুধু মৃতের সংবাদ। বিশ্ব জুড়ে এই মৃত্যুর মিছিল দেখে আজ আমার বড্ড শকুনের কথা মনে পড়ছে। অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারিদিকে উড়তে থাকা পালকহীন গলা ও ঘাড় এবং মাথায় বসানো তীক্ষ্ম দৃষ্টির পাখিগুলো আশির দশকে আমাদের চারপাশে এত বেশি দেখা যেতো যে, বাংলা শকুনকে পৃথিবীর অন্যতম বেশি বিচরণকারী পাখি বলা হতো। প্রশস্ত ডানায় ভর করে আকাশে ওড়া এই শকুনেরা লোকচক্ষুর আড়ালে মহীরুহ বলে পরিচিত বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, ডুমুর প্রভৃতি বিশালাকার গাছে সাধারণত বাসা বাঁধে।
মৃতপ্রাণী খায় বলে একে মাংসাশি পাখি বলে। এর দেহ বিশাল। ডানা প্রশস্ত। দেহের রঙ কালচে। মাথা ও ঘাড় পালকহীন। কান লতিকাহীন। ঠোঁট সরু ও লম্বা। লেজের পালক সংখ্যা ১২-১৪টি। এর দৈর্ঘ্য ৯০ সেমি, ওজন ৪.৩ কেজি, ডানা ৫৫ সেমি, ঠোঁট ৭.৬ সেমি, পা ১১.৬ সেমি ও লেজ ২২.৫ সেমি। এদের খাবারের তালিকায় রয়েছে মৃতপ্রাণী ও পচামাংস। সেপ্টেম্বর-মার্চ মাসে এরা ডিম পাড়ে মাত্র একটি করে। ৪৫ দিনের মাথায় এদের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। উঁচু গাছ বা দালানে ডালপালা দিয়ে মাচার মতো করে বাসা বানায় আর এক বাসাতেই থাকে বছরের পর বছর।
পৃথিবীতে শকুনের ১৮টি প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে ৭টি প্রজাতির শকুনের অস্তিত্ব ছিল। এরমধ্যে বাংলা শকুন (White-rumped Vulture), হিমালয়ী শকুন (Himalayan Griffon), সরু-ঠুঁটি শকুন (Slender-billed Vulture) ও রাজ শকুন (Red-headed Vulture) ছিল এদেশের আবাসিক পাখি। যার মধ্যে দেশে একমাত্র বাংলা শকুনটিই টিকে আছে, অন্যরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রাজ শকুন শেষবারের মত দেখা গেছে ৮০ র দশকে। এখনও হয়ত কোথাও টিকে রয়েছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। এটি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্যে ঠোঁটে পাথরের টুকরো বহন করে নিয়ে তা ডিমের উপর নিক্ষেপ করে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে দেখা যেতো এমন শকুনের অন্য তিনটি প্রজাতি হচ্ছে-কালো শকুন (Cinereous Vulture), ইউরেশীয় শকুন (Eurasian Griffon) ও শ্বেত শকুন (Egyptian Vulture)। এরা মূলত পরিযায়ী (migratory) হিসেবে শীতকালে কখনো কখনো বাংলাদেশে আসে।
লম্বা ঠোঁট শকুন ১৯৯২ সালে ভৈরবে পক্ষিবিদ পল থমসন শেষবারের মতন দেখেন। গিন্নী শকুনের শেষ দেখাও ১৯৮৪ সালে পল থমসনের চোখে। কালো শকুন ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে ধরা পড়ে চাঁদপুরে। পরে এটিকে কুমিল্লা চিড়িয়াখানায় রাখা হয়। গ্রিফন শকুন ১৮ নভেম্বর ১৯৯২ সালে শেষবারের মত দেখা যায় ভৈরবে। বাংলা শকুন টিকে রয়েছে কোন রকমে। অথচ সত্তরের দশকে রাজ শকুন আর বাংলা শকুনে ছেয়ে ছিল ঢাকা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্রগুলোতে দেখা যায় দল বেধে মৃতদেহের উপর বসে আছে তারা। সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির বুদ্ধ নারিকেল গাছের সারিতে আর পলাশী ব্যারাকের কাছের উঁচু গাছগুলোতে দেখা যেত বাংলা শকুনের দল।
বাংলা শকুনের সবচেয়ে বড় দলটি এখন রয়েছে শ্রীমঙ্গলের কালাছড়া এলাকায়। সেখানে একসাথে প্রায় ৪৭টি শকুনের বাস। হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গায় রয়েছে ২০টি শকুন। সুন্দরবনের দিকে বেশ বড় কয়েকটি দল রয়েছে।
বন বিভাগ ও আইইউসিএনের জরিপ অনুযায়ী ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে ১০ লাখ শকুন ছিল। কিন্তু মাত্র একযুগের ব্যবধানে ৯৯ ভাগ কমে ২০১২ সালে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫০টিতে! আইইউসিএনের সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা মাত্র ২৬৮টি! পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সারা বিশ্বে শকুনকে ‘মহাবিপন্ন’ (Critically Endangered) ঘোষণা করেছে আইইউসিএন।
দাড়িওয়ালা শকুন
দাড়িওয়ালা শকুনের কাছে পর্বত খুবই পছন্দের জায়গা। ভারতের হিমালয় থেকে আফগানিস্তান, দক্ষিণ ইউরোপের আল্পস থেকে ককেশাস হয়ে জাগরোস পর্বতমালা, আরব ভূমি, ইথিওপিয়ার পার্বত্য অঞ্চল এবং উত্তর আফ্রিকার আটলাস পর্বতমালা। দেড়েল শকুন দেখতে হলে এদের যেকোনো একটিতে গেলেই হবে। হিমালয়ে ২৪ হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় এদেরকে উড়তে দেখা গেছে। বৈজ্ঞানিক নাম Gypaetus Barbatus। Gypaetus গোত্রের একমাত্র সদস্য দাড়িওয়ালা শকুন (Bearded Vulture) ল্যামারগায়ার (Lammergeier) নামেও পরিচিত।
এরা আর দশটা শকুনের মতোই মৃত পশুর সন্ধানে উড়ে বেড়ায়। তবে মাংস এদের মূখ্য খাবার নয়। অন্য প্রাণীরা যখন মৃত পশুর মাংস খেয়ে শেষ করে ফেলে, তখন এরা জুড়ে বসে। হাড়গোড় এদের প্রধান খাদ্য। অন্যান্য পশুপাখি বা কচ্ছপও খুব পছন্দ। শক্ত হাড় বা কচ্ছপের খোলস ভাঙ্গবার জন্য এরা প্রথমে অনেক ওপরে উড়ে যায়, তারপরে সেখান থেকে হাড় বা খাদ্যবস্তুটা ফেলে দেয়। পাথরে পড়ে হাড় বা খোলস ফেটে গেলে তখন এরা নেমে আসে। ছোটখাট পাখি বা পশুও এরা খায়। আকারে এরা বিরাট, প্রায় ৪ ফুট লম্বা, দুই ডানা মেলে ধরলে মোট বিস্তৃতি দাঁড়ায় নয় ফুটেরও বেশি। বিরাট ডানার প্রবল ঝাপটায় শিকারকে হত্যা করে অনেক সময়। এদের গায়ের রং লালচে হলুদ। মাথা ও বুকে সাদা ছোপ আর লেজ ও পাখনায় ধূসর কালো রং দেখা যায়। প্রাপ্ত বয়স্ক শকুনের চোখের উপরে লোমশ একটি অংশ থাকে যা দাড়ির মতো দেখায়। আর এজন্যই এদের বলা হয় দেড়েল শকুন। এরা সৌন্দর্য সচেতন পাখি হিসেবেও পরিচিত। বর্ণিল পালক, কুঁজের মত পেছন অংশ, পুতির মত চোখ, ন্যাড়া মাথা এসবকিছু মিলিয়ে দাড়িওয়ালা শকুন পৃথিবীর স্টাইলিশ পাখিতে পরিণত হয়েছে। দাড়িওয়ালা শকুন দুটি ডিম পাড়ে, কিন্তু বেড়ে ওঠে একটিই। একটু বড় হওয়ার পরই তুলনামূলক শক্তিশালী বাচ্চাটা অন্যটিকে বাসা থেকে ফেলে দেয়। এরা প্রায় বিপন্ন পাখি। প্রাচীন পারস্যের হুমা পাখির ধারণা মূলত এই দেড়েল শকুনদের ওপরে ভিত্তি করেই এসেছে। গ্রীক পুরাণে এবং বাইবেলেও এদের উল্লেখ দেখা যায়।
শকুন বিলুপ্তির কারণ
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেনারি মেডিসিনের অধ্যাপক লিন্ডসে ওক তাঁর এক গবেষণায় দেখতে পান, শকুন বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এই ওষধু ব্যবহারের পর পশুটির মৃত্যু হলেও মৃত পশুর দেহে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়ে যায়। শকুন ওই মৃত পশুর দেহ খাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ওষুধের প্রভাবে মারা যায়।
লিন্ডসের গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র শূন্য দশমিক ২২ মিলিগ্রাম ডাইক্লোফেনাক একটি শকুনের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ঠ। ১৯৮০ দশকে ওষুধটি ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সস্তায় পাওয়া যায় বলে গবাদিপশুর প্রায় সব রোগেই এই ওষুধটি কৃষকেরা ব্যবহার করতে থাকেন। ফলে দলে দলে মারা যেতে থাকে শকুন। কিন্তু ভারতীয় ভেটেনারি বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, গবাদিপশুর যেসব রোগ হয় তার মধ্যে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে।
এ ছাড়া আইইউসিএন-এর (International Union for Conservation of Nature ) সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশনের মতে, অতিরিক্ত কীটনাশক ও সারের কারণে পানি দূষণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া, বিমানের সাথে সংঘর্ষ, স্থানীয় প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার ইত্যাদি কারণে প্রতিবছর শকুনের ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া খাদ্য সংকট, নিম্ন জন্মহার, বিভিন্ন কারণে বট, পাকুড়, শেওড়া, শিমুল, ছাতিম, দেবদারু, অশ্বত্থ, কড়ই, তেঁতুল, অর্জুন, পিপুল, নিম, তেলসুর ইত্যাদি বড় গাছ ধ্বংসের কারণে বাসস্থানের প্রচণ্ড সংকটও শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। তবে ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের প্রভাব, খাদ্য সংকট এবং বাস উপযোগী বড় গাছ ধ্বংসই বাংলাদেশে শকুন বিলুপ্তির প্রধান তিনটি কারণ। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে এই অবস্থা চলমান থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যেই দেশ থেকে হারিয়ে যাবে শকুন।
সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
শকুন বাংলাদেশের স্থায়ী পাখি। হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতি থেকে মৃতদেহ সরিয়ে রোগ প্রতিরোধ ও পরিবেশকে সুরক্ষা দিচ্ছে শকুনই। এ কারণেই শকুনকে প্রকৃতির ঝাড়ুদার বলা হয়। শকুন আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময় নিচের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায় বলে প্রাণীর মৃতদেহ দেখে নেমে আসে। একদল শকুন মাত্র ২০ মিনিটে একটি গরুর মরদেহ খেয়ে শেষ করে দিতে পারে। একমাত্র শকুন হচ্ছে সেই প্রাণী, যে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত মৃত গরুর মাংস খেয়ে হজম করতে পারে। যক্ষ্মা ও খুরারোগের জীবাণু শকুনের পেটে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।
শকুন সংরক্ষণে সরকার বা বন বিভাগের গৃহীত উদ্যোগ
২০১৪ সালে সুন্দরবন ও সিলেটের ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করেছে সরকার। শকুন রক্ষায় বন বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে আইইউসিএন। হবিগঞ্জের রেমাকালেঙ্গায় শকুনের জন্য একটি ফিডিং সেন্টার খুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে শকুনের খাবার সরবরাহের পাশাপাশি পরিচর্যা ও বিশ্রামের জায়গাও তৈরি করেছে আইইউসিএন। প্রতিষ্ঠানটির প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি বাচ্চা দিয়েছে মা শকুনেরা।
অসচেতনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে যে আবর্জনা নিত্যদিন সমস্যার সৃষ্টি করছে, শকুনের মতো বর্জভূক পাখিরা প্রাকৃতিকভাবে এসব মৃতদেহ ও আবর্জনা খেয়ে পরিবেশকে করছে দূষণমুক্ত। কিন্তু বর্তমানে উপকারী এই পাখিটিবিলুপ্তির পথে। এই পাখিটি সংরক্ষণের জন্য সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস’। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয়। শকুন সংরক্ষন ও তা রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকেই সচেতন করে তুলবে এই দিবসটি তা প্রত্যাশা করা যায়।
বন বিভাগ ও আইইউসিএনের সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর এখন ১০ থেকে ১২টি শকুন বাড়ছে। আশা করি জীবনানন্দ দাশের মত আবার আমরা বলতে পারব
“মাঠ থেকে মাঠে-মাঠে—সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশে-আকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি; নিস্তব্ধ প্রান্তর
শকুনের; যেখানে মাঠের দৃঢ় নীরবতা দাঁড়ায়েছে আকাশের পাশে”
তথ্যসূত্র ও ছবি : আন্তজাল।