হিমালয় নামের সঙ্গেই এর বিশালতা ও দুর্নিবার আকর্ষন জড়িয়ে আছে। আর হিমালয়ের অপার বিষ্ময় মাউন্ট এভারেস্ট। আজ আমরা যাকে মাউন্ট এভারেস্ট বলে ডাকি সে নামের জন্ম মোটামুটি ১৮৬৫ সালের দিকে। তৎকালীন সার্ভেয়র জেনারেল অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ এর সুপারিশ ক্রমে রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি (RGS) জর্জ এভারেস্টের নামানুসারে মাউন্ট এভারেস্ট রাখে। যিনি ছিলেন ওয়াহ এর পূর্বসূরী। এভারেস্ট নাম করণের পূর্বে পর্বতটিকে রোমান ১৫ সংখ্যায় প্রকাশ করা হতো। এর পূর্বে Peak-b হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এই নামগুলো মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সাথে সম্পর্কিত। ব্রিটিশদের অধিকারে যখন তৎকালীন ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপন সম্ভব হয় তখন তারা এ অঞ্চলের ত্রিকোণমিতিক সর্বেক্ষণ (জরিপ) কাজে হাত দেয়। কম্পানি শাসনামলে ১৮০২ সালের ১০ এপ্রিল এই ত্রিকোণমিতিক জরিপ কাজ শুরু হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন উইলিয়াম ল্যাম্বটন (William Lambton) । পরবর্তী প্রায় ৭০ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির হাত ধরে এই জরিপ কাজ এগিয়ে চলে। ১৮১৮ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ছয় জন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক নিরীক্ষাবীদ এই মহা জরিপ কাজের নেতৃত্ব দেন। তারা হলে: উইলিয়াম ল্যাম্বটন, স্যার জর্জ এভারেস্ট, অ্যান্ড্রিউ স্কট, জেমস থমাস ওয়াকার, সিডনী গার্লেন্ড ব্রাড, স্যার জেরাল্ড পনসনবি লেক্স ক্যানিংহ্যাম। এভারেস্ট সনাক্ত ও নামকরণ হয় অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ এর সময়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গটি সনাক্তকরণ ও নামকরণ নিয়ে তখন থেকেই শুরু হয় বির্তক। কেননা নিয়ম ও প্রথানুযায়ী পর্বতগুলোর স্থানীয় নাম গ্রহণ করার কথা। অন্যান্য পর্বতগুলোর ক্ষেত্রে স্থানীয় নাম গ্রহণ বা প্রাধান্য দেয়া এবং আঞ্চলিক নাম না থাকলে জরিপকারী দলের সনাক্তকরণ সংখ্যা অনুযায়ীই নাম গ্রহণ করা হয়েছে। কেবল ব্যাতিক্রম হয়েছে এভারেস্টের ক্ষেত্রে।
বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গটি হিমালয়ের মহালঙ্গুর হিমাল পর্বতমালায় অবস্থিত। তিব্বত ও নেপালের আন্তর্জাতিক সীমান্ত পর্বতটির শীর্ষবিন্দু দিয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে পর্বতটির বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। তিব্বতীয়রা একে চোমোলাংমা (Chomolingma), নেপালিরা সাগরমাথা, চীনারা ওমোলাংমা (Oomolangma) প্রভৃতি নামে ডাকে। দার্জিলিং ও সিকিম অঞ্চলে পর্বতটি দেওধুঙ্গা বা দেবদুঙ্গা (Devadhunga) নামে পরিচিত। কিছু কিছু ইউরিপিয়ান বিশেষত জার্মানরা একে গৌরিশংকর নামে চিহ্নিত করে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো কেন ‘রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি’ স্থানীয় নাম গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেছে। যেখানে পূর্ববর্তী অনেক সূত্রেই পর্বতটিকে চোমোলাংমা (Chomolungma) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিব্বতীয় নামের সন্ধানে : আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রংবুক (Rongbuk) উপত্যকায় অবস্থিত তিব্বতীয় বৌদ্ধদের একটি মঠ বা আশ্রম (monastery) এবং দক্ষিণ তিব্বত থেকে একটি পর্বতশৃঙ্গ দ্যশ্যমান হতো যা স্থানীয়ভাবে চোমোলাংমা নামে অভিহিত। এই পর্বতশৃঙ্গটিই হচ্ছে আজকের মাউন্ট এভারেস্ট। শৃঙ্গটির দক্ষিণ দিকে রংবুক এবং উত্তর দিকে সাঙ্গপো (Tsangpo) উপত্যকা। তিব্বতীয় প্রাচীন নথিপত্রে ঠিক একই যায়গায় চোমো-কানকার (Chomo-kankar ) নামে একটি পর্বতের কথা উল্লেখ আছে। শুধু তাই নয় এর অন্য একটি নামের উল্লেখ পাওয়া যায় চোমো-উরি (Chomo-Uri)।
১৭০৮ থেকে ১৭১৬ সালে চীন সম্রাটের ইচ্ছায় প্রথম হিমালয় অঞ্চলে একটি সমীক্ষা জরিপ হয়। সেই জরিপে Jesuit মিশনারির পুরোহিতরা একটি মানচিত্র তৈরি করেন। প্রথম দিকে মানচিত্রটি ফাদার Regis প্রত্যাখান করেন কারণ এটির কোন ফিক্সড পয়েন্ট ও দূরত্ব উল্লেখ করা ছিলা না। তিব্বতের ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক কথা বিবেচনা করে চীন সম্রাটের আদেশে দুইজন লামা (Carqin zangbu, Lanben Zhaiba ) গণিত ও জ্যামিতিতে দক্ষতা অর্জন করে তিব্বত যান এবং ১৭১২ থেকে ১৭১৭ সালের ভিতর জরিপ সমাপ্ত করে সমগ্র চীনের একটি মানচিত্র প্রণয়ন করেন। মানচিত্রটি প্রথমে মান ভাষায় তাম্র শাষনে ১৭১৯ সালে এবং পরবর্তীতে ১৭২১ সালে কাঠে খুদাই করে তৈরি করা হয়। যার একটি নমুনা (কপি) ফরাসি সম্রাট ১৫ লুই এর কাছে পাঠানো হয়। যা পরবর্তীতে J B B D Anville ১৭৩৫ সালে প্রকাশ করেন। এই মানচিত্রটিতে এভারেস্টের অবস্থানটিকে চোমোলাংকমা (Tchoumou Lancma) হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। যা চৈনিক ভাষায় জুমো লাগমা অ্যালিন (Jumu Lungma Alin) । এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, Joseph Hooker হিমালয়ান জার্নালে উল্লেখ করেন নেপালিরা একটি তুষার শুভ্র পর্বতকে ‘Tsungau’ নামে ডাকে। তিনি তাঁর লেখার ফুট নোটে বলেন, এটিই এভারেস্ট। তিনি দার্জিলিংয়ের দক্ষিণ পশ্চিম সিঙ্গালিলা পর্বত সারি (Singalila Ridge) থেকে এই অতিকায় পর্বতটিকে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু এটা এখন নিশ্চিত যে, তিনি এভারেস্ট দেখতে পাননি। কারণ এখান থেকে এভারেস্ট দৃশ্যমান নয়। তিনি যে পর্বতটি দেখেছিলেন সেটি মাকালো (Makalu) । নেপাল প্রথম আনুষ্ঠানিক জরিপ হয় চার্লস ক্রফোর্ড (Charles Crawford) এর নেতৃত্বে ১৮০১ থেকে ১৮০৪ সালে। কিন্তু সেই জরিপে তিনি কোন উচ্চতম পর্বত লিপিবদ্ধ করতে পারেননি। ১৮১৮ সালে জর্জ এভারেস্ট উইলিয়াম ল্যাম্বটনের সহকারী হিসেবে ত্রিকোণমিতিক জরিপ কাজের সাথে যুক্ত হন এবং পরবর্তীতে ১৮৩০ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত এই কাজের শীর্ষ পদে আরোহণ করেন। জরিপকারী ব্রিটিশ দলটি ভারতের তরাই অঞ্চল থেকে আনুমানিক ১০০ মাইল দূর থেকে হিমালয়কে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। কেননা তখন রাজনৈতিক কারণে স্বাধীন সিকিম, নেপাল ও ভুটানে ব্রিটিশদের প্রবেশাধীকার নিষিদ্ধ ছিল। দলটি তবুও তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। কাঞ্চনজংঘা থেকে ৭০ মাইল পশ্চিমে একটি সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের অস্তিত্ব সনাক্ত করতে পারে দলটি। ১৮৪৮ সালে জরিপকারী দল পর্বতটির সনাক্তকরণ নাম দেয় পিক ১৫। যার ফলস্বরূপ নভেম্বর ১৮৪৯ থেকে জানুয়ারি ১৮৫২ এর ভিতর পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গটি আবিস্কৃত হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি পর্যবেক্ষণ চৌকি থেকে এর গড় উচ্চতা নির্নয় করা হয় ২৯০০২ ফুট ( ৮৮৪০ মিটার)। এখানে একজন বাঙলির নাম এসে যায়। যিনি প্রথম প্রমাণ করেছিলেন এভারেস্টই সর্বোচ্চ চূড়া। তিনি রাধানাথ শিকদার। গণিত, সংস্কৃত, ইংরেজি, গ্রিক ও লাতিন ভাষা-সাহিত্যও ছিল তাঁর দখলে। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম ত্রিকোণমিতি ভিত্তিক জরিপ বিভাগে কাজ করেন (১৮৩২)। ১৮৩১ সালের ২০শে ডিসেম্বর তিনি The Great Trigonometrical Survey কাজে যোগদেন এবং ১৮৩২ সালে সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্ভেয়র হন। দেরাদুনের সিরোন্জ অঞ্চলে জরিপের কাজে যুক্ত হন। রাধানাথ শিকদার দেরাদুনের সার্ভে অফিস থেকে কলকাতার সার্ভে অফিসে বদলি হয়ে আসেন ১৮৪৯ সালে। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে হিমালয় পর্বতমালার ৭৯টি শিখরের উচ্চতা নির্ণয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। এগুলোর মধ্যে ৩১টির স্থানীয় নাম ছিলো আর বাকিগুলোকে রোমান হরফের সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সে অনুযায়ী এভারেস্ট শৃঙ্গকে ডাকা হতো শৃঙ্গ-১৫ (Peak-XV) নামে। হিমালয় পর্বতের সব শৃঙ্গের উচ্চতার মাপ জমা পড়েছিলো কলকাতার গণনা বিভাগে। ১৮৫২ সালে রাধানাথ শিকদার নিকলসনের মাপ-জোক উপাত্তগুলো থেকে ত্রিকোণোমিতিক গণনা করে নিশ্চিত হন শৃঙ্গ-১৫ (Peak-XV) পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। তাঁর হিসাবে এর উচ্চতা ২৯,০০২ ফুট। দেরাদুনে অ্যান্ড্রু ওয়াহকে বিষয়টা জানান তিনি। পরবর্তী কয়েক বছর রাধানাথের গণনাগুলোকে যাচাই বাছাই করার পর অ্যান্ড্রু ওয়াহ নিশ্চিত হন শৃঙ্গ-১৫ (Peak-XV) সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, ১৮৫২ সালে এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করলেও রাধানাথের কৃতিত্ব গোপন করে ইংরেজরা। ১৯৫৬ সালে তাঁর আংশিক কৃতিত্ব স্বীকার করা হয়। যাহোক রাধানাথের আবিষ্কারের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ভারতের প্রাক্তন সার্ভেয়ার জেনারেল কর্নেল সিডনি জেরাল্ড বুরার্ড। ১৯০৪ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা নেচারের (Nature) ১০ নভেম্বর সংখ্যায় “Mount Everest : The Story of a Long Controversy” শিরোনামে এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করে। সারা বিশ্ব জানতে পারে রাধানাথ শিকদার নামের এ অসাধারণ গণিতবিদ সম্পর্কে। ফিরে যাই মূল বিষয়ে।
১৮৫৬ সালে অ্যান্ড্রিউ ওয়াহ সুপারিশ করেন যে peak 15 এর নাম পরিবর্তন করে মাউন্ট এভারেস্ট রাখা হউক। এই সিদ্ধান্তের সাথে ভিন্নমত পোষন করেন Brian Hodgson যিনি নেপালের কাঠমুন্ডুতে বসবাস করতেন। তিনি বলেন, নেপালের স্থানীয়রা এই পর্বতটিকে দেওধুঙ্গা (Devadhunga) বলে। এই নাম বিষয়ে পরবর্তী অনুচ্ছেদে অল্প বিস্তার বলার চেষ্টা করবো। যা হোক ১৯ শতকের শেষ নাগাদ জরিপকারী ব্রিটিশ দলটি বেশ কিছু স্থানীয় (তিব্বতীয়) নাম পায়। নাম গুলো Jomokangar, Jhomogangar এবং Chamokankar কিন্তু এসব স্থানীয় নামের কোনটিকেই তারা বিবেচনায় রাখেননি। যদিও এসব নামের মধ্যে কোন কোনটা তিব্বতীয় প্রাচীন নথিতেই পাওয়া যায়। আরও কিছু নাম যা জরিপকারী দল প্রত্যাখান করে–Deodangar, Bhirab Langur, Bhatab-Than, Nyanam Tangla, Gualham Thangla ইত্যাদি।
নামের বির্তকটি থেমে থাকেনি। RGS কর্তৃক এভারেস্ট নামকরণ গৃহীত হলেও আজ পর্যন্ত এই বির্তক চলে আসছে। নানা তথ্যসূত্রও আবিস্কার হচ্ছে যে, এভারেস্টের একটি স্থানীয় নাম ছিল। ১৯০৭ সালে নাথ সিং (Natha singh) প্রথম ব্যক্তি, যিনি কুম্ভ গ্লেসিয়র ও এভারেস্টের নেপালি পার্শ্ব দর্শন করেন । তিনি স্থানীয়দের কাছে এভারেস্টের নাম শুনতে পান Cholungbif। এছাড়াও ১৯২০ সালে Charles Bell যিনি সিকিমের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি লাসায় দালাইলামা এর সাথে সাক্ষাৎ করে হিমালয়ান রিজয়নে একটি অভিযানের কথা ব্যক্ত করেন। ১৯২১ সালে সেই অনুমোদন তিনি পান এবং পার্চমেন্ট কাগজে তিব্বতীয় ভাষায় লেখা একটা অনুমোদন পত্র Charles Bell কে দেয়া হয়। যার ইংরেজি অনুবাদটি –‘ to the west of the five treasures of the great snow, in the jurisdiction of the white glass fort near Rokey Valley Inner Monastery is the bird country of the south, Lho Cha-Mo Lung. পরবর্তী সময়ে দালাইলামার একান্ত সহকারী বেল কে বলেন Lho Cha-Mo Lung হচ্ছে Cha-Dzi-Ma-Lung-Ma এর সংক্ষিপ্ত রূপ যার অর্থ হচ্ছে- সেই জেলা যেখানে পাখি পালন করা হয়। উল্লেখ্য যে, তিব্বতীয় নথিতে উল্লেখ আছে ৬৫০-৮০০ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতের রাজা অনেক পাখিকে আহার করাতে বেশ খরচ করতেন। সম্ভবত সেই স্থানটি হচ্ছে Rongbuk Valley । কিন্তু বেলের কথা মতো এখান থেকে একটি উপত্যকার কথা পাওয়া যায়। কোন পর্বতের কথা নয়। তাছাড়া কোন কোন বিজ্ঞ জন বলেন যে cha শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে cho নয়। যেখানে cha অর্থ পাখি আর cho শব্দটি একজন নারী দেবীকে বুঝায়। তিব্বতের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক যে সকল পাসপোর্ট দেয়া হয়েছিল সেগুলোতে Cha-Mo Lung ই ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে ১৯৩০ সালে বেল David Mcdonald নামে একজন ব্যবসায়ীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, এভারেস্টের তিব্বতীয় নাম হচ্ছে-Mi-Ji-Gu-Ti Chapu Long Na । যার পূর্নরূপটি সত্যিই রোমাঞ্চকর। আর তা হলো- You cannot see the summit from near it but you can see the summit from nine direction and a bird that flies as high as the summit gets blind. যা হোক বেল যদিও চোমোলাংমা শব্দটির অর্থ করেছেন পাখির দেশ হিসেবেই যেখানে এভারেস্ট দাড়িঁয়ে আছে। চোমোলাংমা শব্দটি পাওয়া যায় আরও একটি উৎস হতে। আর তা হচ্ছে Rongbuk Monastery তে তীর্থ যাত্রায় যাওয়া তীর্থযাত্রীদের বুকলেট থেকে। ১৯৩৬ সালের এভারেস্ট অভিযানে E.G.H Kempson যিনি পেশায় ছিলেন একজন গণিত শিক্ষক। তিনি তীর্থ যাত্রীদের বুকলেটে চোমোলাংমা নামটি পান। এছাড়াও General Bruce (১৯২২ ও ১৯২৪ সালের বিখ্যাত এভারেস্ট অভিযানের টিম লিডার) তার Twenty Years in the Himalaya গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, শেরপা Bhutias এর কাছে তিনি Chomo Lungmo নামটি শুনেছেন যা এভারেস্টকে নির্দেশ করে। এছাড়াও Dr. Kellas তার অভিযানে পোর্টারের কাছ থেকেও স্থানীয় নামটিই শুনতে পান। মোটের উপর বলা যায় এভারেস্টের সর্বাধিক প্রচলিত স্থানীয় নাম চোমোলাংমা। পশ্চিমাদের উচ্চারণ ও স্থানীয় তিব্বতীয়দের উচ্চারণ হতে সঠিক নামের অপভ্রংশ হিসেবে চোমোলাংমার সাদৃশ্যপূর্ণ আরও অনেক নাম দেখা যায়। সবচেয়ে বড় কথা এভারেস্টের একটি স্থানীয় নাম আছে বা ছিল সেটি প্রমাণিত। যাহোক সব স্থানীয় নামকে অগ্রায্য করে ১৮৬৫ সালে এভারেস্ট নামটিই চূড়ান্ত করে RGS। যাদিও প্রশ্নটি থেকেই যায়। কারণ তখন পর্যন্তও জরিপকারী দল নেপালে প্রবেশ করতে পারেনি। দূর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই এভারেস্ট চিহ্নিত হয় এবং যখন নিশ্চিত হয় যে কাঞ্চনজংঘাকে হটিয়ে এভারেস্টই সর্বোচ্চ পর্বত তখন তড়িঘড়ি করেই স্কট ওয়াহ প্রস্তাব করেন peak 15 এর নাম পরিবর্তনের। এর প্রায় এক দশক পর RGS আনুষ্ঠানিক ভাবে এভারেস্ট নামটি গ্রহণ করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অনেকটা সময় যাচাই বাছাইয়ের পর নামটি চূড়ান্ত করা হয়েছে কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮৫৮ সালেই RGS এর মানচিত্রে স্কট ওয়াহ peak 15 কে এভারেস্ট হিসেবে উপস্থাপন করেই মানচিত্র প্রকাশ করেন। আরও একটি বিষয় হলো কোন স্থানীয় নামকে প্রাধান্য না দিলেও যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই ১৮৬২ সালে এভারেস্টকে গৌরিশংকর উল্লেখ করে RGS তাদের কন্টিনেন্টাল মানচিত্র প্রকাশ করে। গৌরিশংকরকে এভারেস্ট হিসেবে প্রথম দাবী করেন শ্ল্যাগিন্টুয়েট ভাইয়েরা। তাঁরা বলেন নেপালে পবর্তটি গৌরিশংকর এবং তিব্বতে চিংগোপামারি (Chingopamari)। কেন অল্প কিছু দিনের জন্য গৌরিশংকর নামটি গ্রহণ করা হলো তা বোধগম্য নয়। কোন কোন সূত্র মতে স্কট ওয়াহ এ নামটিরও বিরোধী ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে তিনি ছিলেন জরিপকারী দলের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। তাঁর সম্মতি ভিন্ন কোন নাম গ্রহণ করা কতটা সত্য হতে পারে। পরবর্তীতে এই বিষয়টা নামকরণ বিতর্ক থেকে স্কট ওয়াহ কে কিছুটা দায় মুক্তি দেয়। তবে কি, RGS জানতো গৌরিশংকর আর যাই হোক কোন ভাবেই peak 15 নয়। স্কট ওয়াহ কি তাহলে ইচ্ছে করেই এমনটি করেছেন যাতে এভারেস্ট নামটির বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা পায়?
শেরপাদের কাছে চোমোলাংমা নামটিই গ্রহণযোগ্য। তার প্রমাণ পাওয়া যায় J.O.M Roberts অ্যালপাইন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক T. S Blakeney কে ১৯৬৫ সালে একটি চিঠি লেখেন যেখানে তিনি বলেন, দুই জন শেরপাকে তিনি অনুসন্ধানি মন নিয়ে জিজ্ঞাসা করে ছিলেন, এভারেস্টকে তোমরা কি নামে ডাকো। দু’জনেই দ্বিধা না করেই উত্তর দিয়ে ছিল চোমোলাংমা (chomolungma) । শুধু তাই নয় সেই শেরপারা তাকে আরও বলেছিল এই নামটি তারা তাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শুনে আসছে। তাহলে এক কথা বলাই যায় নেপাল বা তিব্বতের মানুষেরা পর্বতটিকে চোমোলাংমা হিসেবেই জানে। যদিও একটি কথা মনে রাখতে হবে। তিব্বতীওরা কখনও একক কোন পর্বতকে চিহ্নিত করে নামকরণ করেননি। তারা মূলত কতিপয় পর্বতগুচ্ছকেই একই নামে চিহ্নিত করে থাকেন।
এভারেস্টের আরও যত নাম : পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম দেওধুঙ্গা (Devadhunga) নামটি। এভারেস্ট হিসেবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতটির নাম সুপারিশ করার সময়ই Mr. Brian Hodgson এর বিরোধীতা করেন এবং দেওধুঙ্গা নামে স্থানীয়রা এই শৃঙ্গটিকে চিনে বলে জানান। কিন্তু ১৯০৩ সালে Captin Henry Wood যখন নেপাল ভ্রমণ করেন তখন নেপালে এ ধরণের নাম খুঁজে পাননি। এমনকি নাথ সিং যিনি কুম্ভ গ্লেসিয়ার জরিপকাজে ভ্রমণকরী প্রথম ব্যক্তি, তিনিও দেওধুঙ্গা নাম শুনতে পাননি। ১৯২১ সালের কর্নেল বারীও এ নামটির ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে পারেননি। General Bruce এ ব্যাপারে কোন কিছু উল্লেখ করেননি। তাই ধারণা করা হয় Hodgson দেওধুঙ্গা নামটি নেপালি প্রাচীন সাহিত্য থেকে হয়তো শুনে এভারেস্টের জন্য ভেবে ছিলেন। Hodgson ছিলেন নেপালে বসবাসকারী। অন্যান্যরা কেবল স্বল্প সময়ের জন্যই নির্দিষ্ট কাজে নেপাল ভ্রমণ করেছেন। তাই Hodgson এর মতো নেপালকে তাঁরা হয়তো চিনতেন না বা জানতেন না। দেওধুঙ্গা নামের অর্থটাও স্থানীয় ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। তাই দেওধুঙ্গা (দেবতার গৃহ) নামটি পর্বতটিকে বিশেষভাবে ইঙ্গিত করে তা বলা যেতেই পারে।
১৮৫৫ সালে হারম্যান শ্ল্যাগিন্টুয়েট (Hernann Schlagintweit) ফালুট (Phalut) থেকে এবং ১৮৫৭ সালে কাওলিয় (Kaulia) থেকে পর্বতের পর্যবেক্ষণ করে একটি চিত্র অংকন করেন এবং ১৮৬২ সালে তার প্রকাশনায় তিনি বলেন এভারেস্টেই মূলত দেওধুঙ্গা এবং এর স্থানীয় নাম তিনি বলেন গৌরিশংকর। কিন্তু ১৯০৩ সালে যখন Captin Henry Wood নেপাল ভ্রমণ করেন এবং যেখান থেকে শ্ল্যাগিন্টুয়েট পর্বত পর্যবেক্ষণ করে এভারেস্টকে গৌরিশংকর বলেছিলেন সেখান থেকেই তিনিও পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হন এটি এভারেস্ট থেকে ৩৫ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত peak-20 এবং ১৮৫৫ সালে তিনি যে পর্বতটি দেখেছেন সেটি আসলে মাকালু।
এবার আসা যাক সাগরমাতা নামটির বিষয়ে। সাগরমাতা নামটি ১৯৬০ সালে চীন এবং নেপালের সীমা চিহ্নিত করণের সময় দেয়া হয়। নেপালের প্রাচীন সাহিত্যে সাগরমাতা নামটির দেখা পাওয়া যায়।
প্রশ্নটি থেকেই গেল কেন তাহলে রয়েল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি কোন স্থানীয় নাম বিশেষত চোমোলাংমা কে গ্রহণ করেনি। তাদের যুক্তি চোমোলাংমা কোন একক পর্বতশৃঙ্গকে নির্দেশ করে না। আর ভাষা ও উচ্চারণ ভেদে কাছাকাছি আরও অনেক নাম থাকায় কোন একটি নামকে গ্রহণ করা যায় না । তবে কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ উপনিবেশবাদের ভুততাড়িত এবং পূর্ববর্তী কর্তাব্যক্তির প্রতি মাত্রারিক্ত আনুগত্যতা যা ভারতীয়দের ভাষায় চামচামি বলা যেতে পারে। দেরাদুনে জর্জ এভারেস্টের জমিদারি ছিল এবং একটি হারেমখানও ছিল। যার প্রমান William Makey Aiten তার একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন। যা হোক পরিশেষে আরও একটি কথা বলতে হয় এভারেস্ট নামটি ১৮৪৯ সালে এশিয়টিক সোসাইটির জার্নালে Brian Hodgson এর আর্টিকেল the Physical Geography of the Himalaya এ উল্লেখ করেননি। এমনকি ১৮৪৫ সালে হিমালয়ান জার্নালে প্রকাশিত Hookers map এ উল্লেখ নেই। স্থানীয় নাম নিয়ে যদি জটিলতা থাকেও তবে কেন এভারেস্টের সনাক্তকরণ নাম peak-15 ই রাখা হল না। এক্ষেত্রে অ্যান্ড্রিউ স্কট ওয়াহ এর উপনিবেশবাদী চিন্তার একটি উদাহরণ উপস্থান করা যেতে পারে । ১৮২২ সালে নন্দ দেবী (Nanda devi) পর্বতকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ মনে করা হতো। কিন্তু তখন একই স্থানীয় নাম নেই এই কথা বলে একে A2 হিসেবে ডাকতে শুরু করে ওয়াহ এর জরিপকারী দল। কিন্তু Dhaulagiri পাদপ্রদীপের আলোতে চলে আসায় স্থানীয় নামটিই বহাল থেকে যায়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গটি কিন্তু তার আবিস্কার কর্তা Thomas George Montgomerie এর নামে হয়নি। যেহেতেু স্থানীয় কোন নাম কারাকোরাম রেঞ্জে পাওয়া যাইনি তাই তার সনাক্তকরণ নম্বরই k2 নাম হিসেবে গৃহীত হয়েছে। যদিও বিভিন্ন নাম এর জন্য প্রস্তাব করা হয়ে ছিল। তাহলে কি বলতেই হয় উপনিবেশবাদের ভুততাড়িত নাম নিয়ে চোমোলাংমা এভারেস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তথ্য সূত্র : 1. Everest : Walt Unsworth. 2. The Name of the World’s Highest Peak : Michael Ward. 3. On the Origin of the Himalaya Mountains : Col S G Burrard. 4. A Tibetan Name for Everest : T S Blakeney. 5. Mount Everest : B L Gulatee. 6. The Alpine Journal-The Exploration and Mapping of Everest : Michael Ward. 7. The Supposed Tibetan or Nepalese Name of Mt Everest : N E Odell.
ফিচার ছবি : Andreas-gabler
Awesome post! Keep up the great work! 🙂
ধন্যবাদ