সামাজিক প্রথা ও আইন
একটি জনগোষ্ঠীর সকল কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের শিকড় হচ্ছে সামাজিক আইন। সুষ্ঠু সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থার জন্য প্রথাগত সামাজিক আইন অপরিহার্য। বমরাও তার বাইরে নয়। ১৯১৮ সাল হতে বম জনগোষ্ঠী পর্যায়ক্রমে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়াতে বর্তমানে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে। সামাজিক আচার-আচরণ, বিচার-সালিশ ব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বম সম্প্রদায় ১৯৪৮ সালে ‘বম ডান বু (Bawm Dan Bu)’ নামে একটি আইনের বই প্রণয়ন করে যা, সর্বশেষ ২০১৬ সালে সংশোধিত হয়।
সামাজিক আচার-আচরণ, বিচার-সালিশ ব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বম সম্প্রদায় ১৯৪৮ সালে ‘বম ডান বু (Bawm Dan Bu)’ নামে একটি আইনের বই প্রণয়ন করে যা, সর্বশেষ ২০১৬ সালে সংশোধিত হয়।
এই বইয়ের আইনি নিয়মনীতি তারা কঠোরভাবে মেনে চলে। একে বম জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংবিধান বলা চলে। সংবিধানের নির্দেশনা বিনা বাক্য ব্যয়ে তারা মেনে চলে। পাশাপাশি সামাজিক রীতি-নীতি, প্রথা ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে বম সমাজের নেতৃবৃন্দ সর্বসম্মতভাবে ১৯৮৫ সালে বম সোস্যাল কাউন্সিল গঠন করে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ গ্রামেই সালিশের মাধ্যমে মিমাংসিত হয়। বমরা স্বভাবে নম্র এবং ভাষা অত্যান্ত মোলায়েম। বিশ্রী রকম গালাগালের কোনো শব্দ বম ভাষায় খুঁজে পাওয়া যায় না। নিঃসন্দেহে এটি সুদৃঢ় ভিত্তি সম্পন্ন সামাজিক ব্যবস্থারই ফল। বম সমাজের কেউ এই যাবত নিজেদের মধ্যে সংঘটিত কোনো বিবাদের অভিযোগ নিয়ে বা মীমাংসার জন্য কোর্ট অথবা অন্য কোনো সরকারি সংস্থার শরণাপন্ন হয়েছে বলে জানা যায় না। অতি সম্প্রতি হাতে গোনা দু’একটি বিশেষ করে উপজেলা সদরের নিকটবর্তী গ্রাম থেকে বিবাদের কারণে থানায় যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সোসাল কাউন্সিলের উদ্যোগে তা প্রত্যাহার এবং কাউন্সিলের মধ্যস্থতায় মীমাংসা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে তাদের সমাজে আজ পর্যন্ত গুরুতর কোনো ফৌজদারী অপরাধ সংঘটনের নজির নেই। আইন প্রনয়ণের আগ থেকেই তারা তাদের নিজস্ব প্রথাগত সামাজিক আইন দিয়ে জীবন ধারা পরিচালনা করে আসছে। সংবিধান আকারে আইন বই প্রনয়ণের পর জীবন ধারা পরিচালনার বিষয়টি আরও সুসংগঠিত হয়। কিন্ত কালের পরিবর্তন ধারার সাথে আইনের সময়োপযোগী ও কার্যকর পরিবর্তন না হওয়ায় এ প্রথাগত সামাজিক আইনসমূহ প্রয়োগে বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।
বম জনগোষ্ঠীর সামাজিক আইন প্রধানত তাদের সামাজিক রীতি ও প্রথার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা। বম জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে তাদের সামাজিক, পারিবারিক ও গোত্রগত শৃঙ্খলা এবং শাসন সংহত রাখতে সমাজের সর্বজনগ্রাহ্য বিশেষ কিছু নিয়ম, রীতিনীতি ও প্রথা অনুসরণ করে আসছে। সমাজের বিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় বম সমাজের নেতৃবৃন্দ এসব আচার-আচরণ, রীতিনীতি, বিচার-সালিশ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্যই মূলত প্রথাগত আইনের বইটি প্রণয়ন করে। পার্বত্য জেলাগুলোতে বসবাসকারী অপরাপর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বমদের সামাজিক আইন প্রণয়নের বিষয়টি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সংস্কার, রীতি এবং বিশ্বাস
কেশ বিন্যাসের ক্ষেত্রে বমদের সাথে পাংখোয়াদের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। পুরুষদের মাথার চুল দীর্ঘ হওয়াটা তাদের সমাজে সৌন্দর্যের ব্যাপার বলে বিবেচিত হতো। পাংখোয়া ও লুসাইরা মাথার সম্মুখভাগে এবং বমরা তাদের চুলের ঝুঁটি পেছনের দিকে বাঁধে। অতীতে তাদের সমাজে মাথায় এই ঝুঁটি ও বিভিন্ন রঙের পাগড়ী এবং ফিতা বাঁধার বিষয়টি ব্যক্তির পদমর্যাদা নির্ণয়ে সহায়ক হতো বলে জানা যায়। বম তরুণেরা ঝুঁটিতে অনেক সময় চুল সমেত একটি কালো কাপড় বল আকৃতির করে বেঁধে রাখতো, যাতে খোঁপাটি বড় দেখায়। তাদের মধ্যে ঝুঁটিতে লাল ফিতা ব্যবহার সম্পর্কেও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে’। একদিন কাঠবিড়ালি ও শিংওয়ালা এক প্যাঁচার মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেধে গেল। কাঠবিড়ালি প্যাঁচার মাথায় কামড় দিলে প্রচন্ত রকমের রক্তপাতে প্যাঁচার মাথা ও সমস্ত শরীর রক্তে ভেসে যায়। তারপর যখন কাঠবিড়ালি প্যাঁচার রক্তাক্ত চেহারা দেখল, সে ভয় পেয়ে গেল এবং দৌড়ে পালালো। এরপর প্যাঁচা কাঠবিড়ালির বাসায় হানা দিয়ে সব ছানা খেয়ে ফেললো। এদিকে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট জনৈক বনযোগী বা বম প্রধান কোয়াভাং (সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত বিশেষ মানব) ছিলেন এই ঘাটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী। ঘটনার পর এক বাঘ এসে তাকে জানায়, তিনি এতক্ষণ যা দেখলেন তা আসলে দেবতা খুজিং থেকে আসা বাণী বা ইঙ্গিত। কোয়াভাং পুরো ব্যাপারটি অনুধাবন করলেন এবং এর পর থেকে যে কোনো যুদ্ধ যাত্রার প্রাক্কালে রক্তাক্ত মাথার যুদ্ধজয়ী পেঁচার অনুরূপ তাদের মাথায় লাল রঙের ফিতা ব্যাবহার করা শুরু করে। বিশ্বাস অনুসারে এই লাল ফিতার ব্যবহার তাদেরকে যুদ্ধ জয়ে বিশেষ সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।’
বম সমাজে জুম থেকে ধান কাটা বা সংগ্রহের ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র একটি রীতি আছে। যেমন: চাকমারা ধান কেটে ঝুড়িতে করে ভরে নিয়ে আসে আর বমরা ধান গাছ কেটে আঁটি করে বেঁধে নিয়ে আসে।
অতীতে বমরা মৃত দেহকে পোড়াতো। আবার মান্যগণ্য গ্রাম প্রধানকে বসা ভঙ্গি বা আকৃতিতে সমাহিত করার প্রচলনও ছিল। দাহ করার ক্ষেত্রে উত্তর দিকে পা এবং দক্ষিণে মাথা রেখে কার্য সস্পাদন করা হতো। বর্তমানে দাহ করার রীতি আর নেই। খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুযায়ি পুরুষদের পূর্ব-পশ্চিম এবং নারীদের পশ্চিম-পূর্ব করে সমাহিত করা হয়। সমাহিত করার ক্ষেত্রে মৃত দেহকে আলাদা কাপড় বা বস্ত্রে আবৃত করার প্রয়োজন পড়ে না। জীবদ্দশায় ব্যাবহার্য পরিস্কার সাধারণ পোশাক পড়িয়েই সমাহিত করা হয়। শুধু মৃত দেহের উপর ‘ মিথি পুওন’ নামের তাঁতে বোনা বস্ত্র দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। অনেক সময় মিথি পুওনের ব্যবস্থা মৃত ব্যক্তির পরিবারকে করতে হয় না। আত্মীয়রাই সাথে করে নিয়ে আসে। বস্ত্রের পরিমান একের অধিক হলে তা পরোবর্তীতে অন্য কারও বেলায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করা হয়। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে মৃতের বাড়িতে উপস্থিত সকল আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়ণ বা খাবারের ব্যাবস্থা পাড়া প্রতিবেশিরা সমন্বিতভাবে করে থাকে।
তাদের এক রাজা ‘নগুংগিয়ুংনাংয়ে’র আমলে বমরা এই অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিল বলে দাবি করে। এখন কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তারা মনে করে যে, আগের প্রধান না থাকার জন্যই এমন হচ্ছে। তাদের বিশ্বাস আগের প্রধানদের প্রতি দেবতার আশীর্বাদ থাকতো।
দেবতা খুজিং-এর বাসস্থান নিয়ে তাদের মধ্যে এক বিশ্বাসের প্রচলন রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে দেবতা খুজিং কাছেই কোনো পাহাড়ে বাস করেন। অমরত্বের অধিকারী নয় এমন কেউ সেই গৃহে প্রবেশ করতে পারে না। একবার এক বম প্রধান লুসাইদের সাথে যুদ্ধ শেষে ফেরার পথে খুজিং-এর গ্রাম দেখতে পান। এক উঁচু পাহাড়ের উপরে চারিধার সাদা আর লাল কাপড়ে ঘেরা। প্রধান তখন সেই গ্রামে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর তিনি ১০ দিন ধরে সেই পাহাড়ের দিকে হেঁটে চললেন কিন্তু একটুও নিকটে পৌঁছতে পাড়লেন না, বরং আস্তে আস্তে গ্রাম এবং পাহাড় তার চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল, আর দেখা গেল না। তখন প্রধান বুঝতে পারলেন সেটা ছিল সত্যিই খুজিয়াং-এর গ্রাম।
ধর্মান্তরিত হবার আগে বমরা পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিল। তবে সবার পক্ষে পুনর্জন্ম লাভ করা সম্ভব নয়। যারা পৃথিবীতে খারাপ বা মন্দ কাজের মধ্য দিয়ে জীবন কাটায় তারা আর ফেরৎ আসতে পারে না। ভালো বা পূণ্যময় জীবন কাটালে খুজিং সন্তুষ্ট থাকে, আর তিনি সন্তুষ্ট থাকলে কাউকে তার ইচ্ছা মত অন্য কোন দেহের মাধ্যমে পৃথিবীতে ফেরত পাঠান।
অতীতে তাদের সমাজে মানুষ বলি দেয়ার রীতি ছিল। এখনও অনেকেই মনে করে মানুষ বলি দিতে পারলে আরও বেশি করে দেবতাকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব। কিন্তু প্রসাশনের নিষেধের কারণে বর্তমানে তা একটি অসম্ভব কাজ। লেউইন প্রদত্ব এই তথ্য থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আগমনের অব্যবহিত আগে বা পরে মানুষ বলির রীতি চালু ছিল। আর লেউইন ছিলেন অত্র এলাকায় ব্রিটিশ সরকারের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে অবশ্যই অশুভ শক্তির খোঁজ খবর নেয়া হয়। খুব সতর্কতার সাথে বিভিন্ন কিছু লক্ষ করা হয়। যেমন: মোরগের ডাক, ডিমের ভেতরের রং এর পরিবর্তন ইত্যাদি। হরিণ দেখা কুলক্ষণ কিন্তু বাঘ দেখতে পাওয়া ভাল লক্ষণ। কে কি স্বপ্ন দেখে, এই বিষয়টিও বিয়ে পাকা হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
কারও অসুখ হলে সুস্থ্যতার জন্য দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হতো। কারণ তারা বিশ্বাস করতো দেবতা রুষ্ট হওয়ার কারণেই রোগ-বালাই দেখা দিয়েছে। বমরা ওষুধপত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। সব ধরণের অসুখের ক্ষেত্রে শূকরের নাড়িভুঁড়ি ও মলমুত্র মদের সাথে মিশ্রিত করে ব্যবহার করাই ছিল একমাত্র চিকিৎসা। এমন আরও অনেক বিশ্বাস তাদের মধ্যে কাজ করতো, যার মধ্যে এখনও কিছু কিছু বিদ্যমান।

ধর্মীয় বিশ্বাস
বম জনগোষ্ঠী গত শতাব্দীর শুরুর দিকেও জড়োপাসক ছিল। জড়োপাসক বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভূত-প্রেত, ঝাড়-ফুঁক, ওঝা-বৈদ্য, জ্যোতিষবিদ্যার প্রতি বিশ্বাস ছিল। বমরা খুজিংকে বিধাতা পুরুষ মানে। তারা বিশ্বাস করে তিনি স্রষ্টা, তিনি কখনও রুষ্ট হন না এবং তিনি সদা কল্যাণময়। তাই বমদের বিধাতা পুরুষের প্রতি পূজা, যজ্ঞ, বলিদান, অর্ঘ্য নিবেদন কিছুই করতে হয় না। কেননা তিনি কারও অমঙ্গল করেন না। তারা বিশ্বাস করে যে পাহাড়ের কোথাও বিধাতা পুরুষের অবস্থান আজও বিদ্যমান তবে কোন মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। তাদের সমাজে যত পূজা, যজ্ঞ, অর্ঘ্য নিবেদন করা হয় সবই অপদেবতাদের উদ্দেশ্যে। কারণ যত অকল্যাণ, ব্যাধি-মৃত্যু, ফসল হানি, খরা-অনাবৃষ্টি, মহামারি সব তাদেরই কীর্তি। তাদের তুষ্টি বিধানের জন্যই যত পূজা, আর্চনা, যজ্ঞ-বলিদান, অর্ঘ্য নিবেদন আবেদনের আয়োজন করা হয়। সেই উদ্দেশ্যে হরেক রকমের বিচিত্র নিয়মকানুনের মাধ্যমে যেসব পূজা আর্চনা বলিদান বা ইত্যাদি পালন করা হয় তার নাম ‘বলশান’। সমস্ত বলশানের পুরোহিত্য করেন ‘বলপু’ অর্থাৎ ধর্মীয় নেতা। ধর্মান্তরিত লুসাইদের প্রভাবে বমরাও ধর্মান্তরিত হয়। বর্তমানে বমদের সকলেই প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। সমগ্র বম সমাজ ৭ থেকে ৮টি ধারার প্রটেস্ট্যান্ট চার্চের অধীন। ১৯১৮ খৃস্টাব্দ হতে বম জনগোষ্ঠী পর্যায়ক্রমে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়াতে বর্তমানে এদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিক রীতিনীতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর খ্রিস্ট ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালন করলেও তারা এখনও প্রাচীন কিছু সংস্কারে বিশ্বাসী। বমদের জীবনধাণের প্রধান অবলম্বন জুম চাষকে কেন্দ্র করেই ‘বলশান’ বা পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদ্ধতিতে পূজা-পার্বণগুলো আয়োজন হয়ে থাকে। নিম্নে তার দু’একটি বর্ণনা দেওয়া হল।
খুয়া-টেম: খুয়া-টেম অর্থ পাড়া শুদ্ধি বা শুচিকরণ। বম সমাজে গুরুগম্ভীর এবং অত্যাবশ্যকীয় অনুষ্ঠান এটি। মূলত পাড়ার কল্যাণ কামনায় খুয়া-টেম অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তাদের বিশ্বাস অসুখ-বিসুখ, জুমে ধানের শীষ সাদাটে হওয়া, ভুট্টার গাছ বা কুমড়ার লতা লিকলিকে শীর্ণকায় থাকা, এসবই হয়ে থাকে ‘জল খুরী’ অপশক্তির কারণে। সে পাড়ায় আস্তানা গাড়ার কারণে হয়ে থাকে যত অকল্যাণ, পীড়া, মৃত্যু আর ফসলহানি। এই অপশক্তি বিতাড়নের আয়োজনই হল পাড়া শুদ্ধি বা খুয়া-টেম। গ্রাম শুচিকরণ অনুষ্ঠানে পাড়ার নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোর সকলের অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। গ্রামের লোকেরা নাম জানা, না জানা নানান বৃক্ষের শিকড়, বাকল, লতাগুল্ম, আধপোড়া খড়ি, কয়লা, নানান রকম পশু-প্রাণীর হাড়ের টুকরো, মাটির হাঁড়ির ভাঙ্গা টুকরো, সংগ্রহ করে পাড়ার মধ্যস্থানে স্তুপ করে রাখে। তারপর সবগুলো কুচি কুচি করে কাটে বা ভাঙ্গে। এবার হলুদ এবং চুন মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে কুচি করে কাটা মিশ্রণগুলোকে রঙ্গিন করে নেয়। এই মিশ্রণ পাড়াময় ছিটানো হয় বসবাসের ঘরে, মুরগির ঘরে, গোলাঘরে, গোয়ালঘরে, ঢেঁকিশালায়, ঘরের মাচার নীচে, পোকার গর্তে, মাটির ফাঁক-ফোঁকর সর্বত্রই। পাড়ার বলপু মশাই মিশ্রণের এক মুঠি হাতে নিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করেন-
‘পাড়ার যত অকল্যাণের আখড়া তুই , নাম তোর কি জানি না,
তোর আস্তানা ঠিক কোনো গর্তে, জানি না-কাঁকড়ার গর্তে?
গাছের ফাঁকফোকরে? ছনের চালের কোনো কোণায়?
নাকি কোনো মানুষের নাকের, কানের গর্তে?
যেখানেই ঠাঁই নিস না কেন আজ তোর বিদায়।
যা, দূর হ, ঐ দূর পর্বত শৃঙ্গে যা,
পূর্ব কি পশ্চিম, উত্তর বা দক্ষিণ তোর তো সীমাহীন আস্তানা
সেথায় যা না!’
মঙ্গল প্রার্থনার পর নারী-পুরুষ সকলেই চুন এবং হলুদে চুবানো রঙিন করা ফিতা হাতে, গলায় অথবা কানে পরিধান করে। এ ফিতা এক সপ্তাহ গায়ে রাখাতে হয়।
বেলা পড়ে এলে গ্রামের চারিদিকে ডাকাডাকি, খোঁজ-খবর করা হয়, এ সময় প্রতিটি মানুষ গ্রামে ফেরা চাই। সকলেই ফিরেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে পাড়ার সব বাড়ির লোক গণনা করা হয়। পাড়ার বাইরে আর কেউ নেই- এটা নিশ্চিত হবার পর চার হাত লম্বা বাঁশের ফালি দিয়ে রংধনুর মতো বাঁকা করে পুঁতে পাড়ার সকল প্রবশ পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর পাড়ার কোনো লোকের বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই। কার্যত বাইরের সাথে গোটা গ্রামবাসী বিচ্ছিন্ন। গ্রামের কারও বাড়ির উঠানে, আঙিনায় বা চালে এক টুকরো কাপড়ও টাঙানো থাকতে পারবে না। কারণ কোন কাপড়চোপড় বিশেষ করে মেয়েদের পরিধানের বস্ত্র ঘরের বাইরে থাকলে তা পাড়া শুদ্ধি বা গ্রাম শুচিকরণ অনুষ্ঠানকে অকার্য়কর করে দেয়। সুতরাং, বিষয়টি খুবই সতর্কতার সহিত দেখা হয়। এই খুয়া-টেম এর দিনের হরেক রকম কার্যাদিও নিয়ম মাফিক সম্পন্ন করতে হয়। বিশেষ রীতিতে অতি সতর্কতার সহিত ঝর্ণার পানি তুলতে হয়। পিঠের থুরুং (বাঁশ দিয়ে তৈরি ঝুড়ি)-এ করে লাউয়ের খোলে পানি আনার সময় পাত্র উছলে পানি গড়িয়ে কারও পিঠ বা কাপড় ভিজলে খুয়া-টেম অনুষ্ঠান অকার্যকর হয়ে যায়।
পাড়ার সকল নারী-পুরুষ অপশক্তি বিতাড়নের মহৌষধি মিশ্রণ যে যার থুরুং-এ ভরে নেয়। সবার হাতে থাকে একটি করে শলাঝাড়ুর মতো ফালি ফালি করা প্রায় এক হাত লম্বা বাঁশ। এবার পাড়াময় মিশ্রণ ছড়াতে হয়। হৈ রৈ চিৎকার সহ বাঁশের ঠোকাঠুকি, প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে সজোরে আঘাত, আর সমস্বরে আওয়াজ তোলা হয়, দূর হ, দূর হ! এমনি করে পাড়ার মাথায় শেষ হয় হৈ রৈ মিছিলটি। এরপর থুরুং আর বাঁশের ঝাড়ুগুলো উল্টো করে স্তুপ করে রেখে প্রত্যেকে যে যার ঘরে চলে যায়। অতঃপর সব কোলাহল বন্ধ, পাড়াময় নেমে আসে নীরবতা আর নিস্তব্ধতা। অনুষ্ঠানের দিনগত রাত্রি আর পরের দিনের জন্য কোন কথা বলা নিষিদ্ধ। সূর্য অস্তে গেলে পাড়া জুড়ে বিরাজ করে এক ভূতুরে নিরবতা।
পার্বত্য এলাকায় অরণ্যের প্রায় সকল নৃগোষ্ঠীর কাছে পাড়াশুদ্ধিকরণ এক অত্যাবশ্যকীয় অনুষ্ঠান। এর অবশ্য নির্দিষ্ট দিন-মাস নেই, সমাজে বয়ে যাওয়া বিচিত্র ঘটনাপঞ্জি এবং প্রকৃতির খেলাই এই অনষ্ঠান আয়োজনের নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।
লৌ থিং কুং বল: প্রতিটি জুমবছরই হাসি কান্নার স্মৃতিতে ভরা। যে জুম সারা বছরের খাদ্য যুগিয়েছে, সুস্বাস্থ্য দিয়েছে সেই জুমের আত্মা পরোবর্তী তিন বছর চাষী বা মালিকের পিছু ছাড়ে না। সুতরাং, জুমের প্রতি অকৃতজ্ঞতা বা অবহেলা করলে চাষীর অমঙ্গল হয়। তাই জুমের অত্মার সন্তুষ্টি বিধান অত্যান্ত জরুরী একটি বিষয়। লৌ থিং কুং বল হল জুম আত্মার সন্তুষ্টি বিধানের পূজা। পূজার আগের দিন পাড়ার মেয়েরা ঢেঁকিতে বিন্নি চালের আটা কোটে। পুরুষরা খুব ভোরে উঠে জুমে যায়। সারা জুম পথে চালের গুড়া ছিটাতে ছিটাতে যায়। জুমে পৌঁছলে জুমের জন্য জঙ্গল কাটার প্রথম দিনে একটি গাছের নীচে যে পথরটি মাটির নীচে পুঁতে রাখা ছিল তা খুঁজতে থাকে। সেই গাছ এবং পাথর খুঁজে পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়, কখনও কখনও সারা দুপুর পেরিয়ে যায়। পাথরটি খুঁজে পাওয়া মাত্র সকলেই আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠে এবং জুমের মাটি কপালে মেখে নেয়। সেই পাথরটি আবারও যেখানে জুম আলুর গর্ত আছে তার পাশে লম্বালম্বিভাবে পুঁতে রাখে, পাশে একটি মারফা ও একটি বাঁশের চোঙ্গাও পুঁতে রাখা হয়। পুঁতে রাখা পাথরের উপরে চালের গুড়া ছিটিয়ে মোরগ আথবা শূকর বলি দেয়া নিয়ম। তারপর মাংশগুলো পূজার ডালায় নিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে-
’কোথায় সব তোমাদের বসতি চিনি না, জানি না, কাঁকড়ার গর্তে?
গাছের ফাঁকফোকড়ে? পাথরের গর্তে? জুমের কোনো প্রান্তে?
যেখানে থাকো বেরিয়ে এসো, এই দেখো তোমাদের উদ্দেশ্যে
আমাদের অর্ঘ্য। এই যে মারফা, এই যে দুই মুঠো শূকর, এই যে মোরগ,
এসো সন্ধি করি, আত্মীয় কুটুম করি, হৃষ্টপুষ্ট ধানের শীষ প্রার্থনা করি,
সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা করি।’
এরপর পুঁতে রাখা পাথরটির চারিদিক বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। পূজার ঘরের মত ঘর বানিয়ে তাতে ফুল, কলাপাতা ও মোরগের পালক দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। তার মধ্যে রান্না করা মাংশ কলা পাতায় করে এবং তরিতরকারি প্রভৃতি উৎসর্গ করা হয়। সবশেষে কিছু কাঁচা মাংস কলার পাতায় বেঁধে ঘরে ফেরার পথে প্রতিটি গাছের গোড়ায় রেখে আসা নিয়ম। প্রতিটি গাছ যেন আরাধ্য দেবতা। ঠিক তার পরের দিন জুমের মালিকের জুমে যাওয়া নিষেধ।
রুয়া-খা-জার: রুয়া-খা-জার এমন এক পূজা, যার মাধ্যমে জুমের ফসল ভাল হওয়ার জন্য বৃষ্টির কামনা করা হয়। অনাবৃষ্টি ও খরা উভয়’ই জুমের জন্য হানিকর, তাতে ফসল ভাল হবে না অথবা পাকা ফসল ঘরে তোলা যাবে না। ফলে অবধারিতভাবে জীবন বিপন্ন হবে। সুতরাং, অপদেবতার কোপদৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এবং অনাবৃষ্টি অথবা অতিবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রুয়া-খা-জার এর আয়োজন খুবই জরুরী। প্রতি পূজায় জীব বলি অত্যাবশ্যক হলেও এই বৃষ্টি আহ্বান অনুষ্ঠানের জন্য কোনো জীব বলি অত্যাবশ্যক নয়, এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ নেই। জুমের আগাছা, লতাগুল্ম, জঙ্গল পরিস্কার শেষে যে কোন একটি দিন বৃষ্টি কামানর জন্য ঠিক করে নেয়।
পাড়ার মেয়েরা খুব ভোরে ঝর্ণায় পানি আনতে যায়। পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা লাউ-এর খোলে পানি ভরে থুরুং-এর মধ্যে অতি সতর্কতার সাথে একটির উপর আরেকটি বসিয়ে নেয় যাতে উল্টে গিয়ে পানি পড়ে না যায়। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে উঠা-নামার সময় থুরুং-এ সাজানো পানির পাত্রগুলো সুশৃঙ্খলভাবে থাকা চাই। যাদের পিঠ ভিজে যায় বা সারা পথে যার পানি পরে পথ পিছলিয়ে দেয় তার যথেষ্ট দুর্ণাম হয়। পুরুষেরা বাড়ির চারিদিকের জঙ্গল পরিস্কার করে, ঘরের মাচার নিচে ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করে। ঘরের নিচ দিয়ে বৃষ্টির পানি যাতে না বয়ে যায় তার জন্য চারপাশ দিয়ে নালা কাটে, সিঁড়ি মেরামত করে, প্রয়োজনে বাঁশ পাল্টিয়ে দেয়। জীব বলি না থাকায় এই রুয়া-খা-জার-এ তেমন আনুষ্ঠানিকতা নেই।
এছাড়াও বম সমাজে রয়েছে আরও বেশ কিছু পূজা-পার্বনের আয়োজন। বর্তমানে বম, পাংখুয়া এবং লুসাইরা শতভাগই খ্রিস্টান। তাদের মাঝে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার শুরু ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে। ভারতের মণিপুর ও মিজোরামের একই ভাষাভাষী স্বগোত্রীয় লুসাইরা বমদের কাছে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। তারা ভারতের মণিপুর রাজ্যের চুরাচাঁদপুর-এ অবস্থিত নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া জেনেবাল মিশনে চাকরি করতেন। এই মিশন তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মিশনারি কাজে প্রেরণ করে। স্থানীয় লোক প্রেরণের পূর্বে এক আমেরিকান মিশনারি রোলান্ড এডউইন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে এতদঞ্চল পরিভ্রমণ করেন।
সূত্র: পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বম-ফেরদৌস জামান, বেজক্যাম্প বাংলাদেশ লি.।
ছবি : মাসুদ রায়হান ও লেখক।