আলীকদমের সাথে প্রাণের একটা টান অনুভব করি। অনেকগুলো কারণের একটি হল এর সংরক্ষিত বন অর্থাৎ সাংগু-মাতামুহুরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সুউচ্চ শতবর্ষী গাছের সারি, তার মাঝ দিয়ে ধোঁয়ার মত মেঘেদের উড়ে চলা আর নাম না জানা কত পাখির কিচির মিচির সব মিলিয়ে মায়াবী, আদিম বন্য প্রকৃতি । সেই টানেই কয়েকদিন আগে এই বনের মাঝে এক দুর্গম পাহাড় ওয়ালি তং আরোহণ অভিযানে বের হয়েছিলাম আমরা চারজন। আসলে রেইনফরেস্টের প্রাণবন্ত রূপ দেখার জন্য বর্ষাকালের চেয়ে ভালো সময় আর হতে পারে না।
ওয়ালি তং সীমানা নির্ধারক পাহাড় যার দক্ষিণ-পশ্চিমে মায়ানমার, মূলত মাতামুহুরি রিজার্ভ এই সীমানাতেই এসে শেষ হয়েছে। পাহাড়ি নদী মাতামুহুরির জন্ম হয়েছে এই সীমান্ত অঞ্চলের পাহাড় থেকে উৎপন্ন ঝিরিগুলো থেকে। সাংগু-মাতামুহুরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি ম্রো আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। আমার মতে দেশের সবচেয়ে ভালো, ভদ্র, আতিথেয়তা প্রবণ মানুষগুলো এই প্রান্তেই থাকে। একের পর এক অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণা, ঝিরি দেখতে দেখতে আমরা রিজার্ভ ফরেস্টের আরও ভিতরে ঢুকছি। মূলত তৈন খাল এর উৎপত্তিস্থলের পর থেকেই রিজার্ভের ছোঁয়া পাওয়া যায়। ‘নন খ’ পাহাড়ের দক্ষিণে আমরা যতই এগোচ্ছি, বনের গভীরতা ততই বাড়ছে।

এই অভিযানে অনেকগুলো ম্রো পাড়া দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাদের খাবার খেয়েছি, খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি তাদের দৈনন্দিন জীবন, সুখ-দুঃখ আর জীবনদর্শন। প্রকৃতির মাঝে বসবাসকারী মানুষগুলোর জীবন প্রকৃতিকে ঘিরেই। এই প্রকৃতি থেকেই জীবন ধারণের বেশীরভাগ জিনিস তারা সংগ্রহ করে থাকে। তাদের ঘর, ঘরের আসবাবপত্র সব কিছুতেই প্রকৃতির ছোঁয়া আর গন্ধ লেপ্টে আছে। আমাদের অভিযান আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ছিল। তখন পাহাড়ে ফসল তোলার মৌসুম তাই ব্যস্ততাও বেশি। জুমের ধান পাকতে শুরু করেছে তাই দ্রুতই কেটে না ফেললে বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসের জন্য ধান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সামর্থ্যবান সব নারী পুরুষই ধান কাটায় ব্যস্ত, এমনকি শিশুরাও এটা ওটা সাহায্য করছে। যদি পাড়া থেকে জুম অনেক দূরে হয়, তাহলে এই সময় গৃহস্থালি জিনিসপত্র, খাবার, গৃহপালিত পশু ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এক মাস বা তারও বেশী সময়ের জন্য তারা জুমঘরে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এতে একদিকে যেমন কাজের সুবিধে হয়, অন্যদিকে পাড়ায় যাওয়া-আসার সময়টুকু বেঁচে যায়। ম্রো আদিবাসীরা এমনিতেও প্রচুর পরিশ্রমী হয়, বিশেষ করে ম্রো মেয়েরা। আমার পর্যবেক্ষণ বলে মেয়েরাই একটি ম্রো পরিবারের মূল চালিকাশক্তি। ফসল ফলানোর কাজ, কাটার কাজ, ধান মাড়াইয়ের কাজ, সাংসারিক কাজ, বাচ্চা সামলানো, কাপড় বুনন’সহ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন দম ফেলার ফুসরত থাকে না তাদের। বছরের এই সময়টাতে পাহাড়ে খাবারের প্রাচুর্যতা কম থাকে। ধান পাকলেও জুমের অন্যান্য ফসল যেমন ভুট্টা, মারফা, মিষ্টি কুমড়ো, চাল কুমড়ো ইত্যাদি পরিপক্ক হতে আরও কিছু দিন সময় লাগে। তাদের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় আমিষের অভাব পরিলক্ষিত হলো ভালো ভাবেই। নাপ্পি-মরিচ ভর্তা আর বাঁশকোড়লই এই সময় খাবার তালিকায় বেশি থাকে।

ম্রোদের মাঝে দুইটি ধর্ম রয়েছে- বৌদ্ধ ও ক্রামা ধর্ম। ‘চিয়াসত পয়’ আর ‘ক্রামা পয়’ হচ্ছে এই দুই ধর্মের দুটি প্রধান উৎসব। এছাড়াও তাদের মাঝে আরও নানান রীতিনীতি রয়েছে। যেমন একজন ম্রো যুবক যদি কোন ম্রো নারীকে বিয়ে করতে চায় তাহলে মেয়ের বাবাকে ঐ যুবকের রূপার একশো দশ টাকা বা এক লক্ষ দশ হাজার টাকা দিতে হয় এবং মেয়ের মাকে দুধের দাম বাবদ দশ হাজার টাকা দিতে হয়। এই রূপার টাকা হচ্ছে আসলে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলের প্রচলিত মুদ্রাগুলো। ম্রো সমাজে একটি মুদ্রার দাম ধরা হয় এক হাজার টাকা। তবে নগদ টাকা না থাকলে মেয়ের বাবাকে সমপরিমাণ সম্পদ যেমন- গরু বা গয়াল দেওয়ারও রীতি প্রচলিত আছে। এজন্য ম্রো পরিবারে কন্যা সন্তানের আলাদা কদর আছে।
দক্ষিণে এগোতে এগোতে আমরা চলে এসেছি সীমান্তের কাছাকাছি চিম্বুক রিজ লাইনের উপরের সর্বশেষ গ্রামে। বনের একেবারে মাঝে নয় পরিবারের একটি গ্রাম। পাড়ার চারপাশে শুধু সুউচ্চ গাছের সারি, একেবারে ঘন বন যাকে বলে। এই পাড়ার পাশের ঝিরিটাই মাতামুহুরি নদীর প্রধান সোর্স ঝিরি হিসেবে বিবেচিত হয়, নাম মাতা ঝিরি বা আন্দালি ঝিরি। পাড়ায় কয়েকজন জুম চাষের পাশাপাশি শিকারও করে থাকে। প্রায়ই কিছু বনবিড়াল গোত্রের প্রাণী সহজ খাবারের লোভে পাড়ায় চলে আসে। পাড়ার মানুষেরা যদি দেখতে বা বুঝতে পারে তাহলে ফাঁদ পেতে বা গুলি করে সেই প্রাণীকে শিকার করে। এমন একটি ব্যর্থ শিকার প্রচেষ্টা আমরা দেখেছিলাম। সেই রাতে গাদা বন্দুকের বারুদ নষ্ট হওয়ায় বেঁচে গিয়েছিল মুরগী খেতে আসা বনবিড়ালটি। এই প্রাকৃতিক বন অনেকগুলো বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণীর একমাত্র আবাসস্থল। যার ভিতর রয়েছে ওরিয়েন্টেড হর্নবিল, জায়ান্ট আরাকান টারটেল, ক্লাউডেড লেপার্ড, এশিয়ান ভাল্লুক, কয়েক প্রজাতির দুর্লভ বনবিড়াল, গয়াল, সজারু, বনরুই, বিভিন্ন প্রজাতির বানর ও হনুমানসহ আরও অনেক প্রাণী। এমন একটি বন যে কোন দেশের জন্য সম্পদ। শুধু তাই নয় এই এলাকার জলবায়ু নিয়ন্ত্রণেও এই বনের ভূমিকা অপরিসীম।
কিন্তু দুঃখ হয় যখন দেখি চোখের সামনে এই বন আর বনের প্রাণীরা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ধীর গতিতে হলেও ক্রমশ এই সংরক্ষিত বনের মাঝে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বসতিগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে, তিন ঘরের পাড়া (পাহাড়িগ্রাম) আজ নয় ঘরে রূপান্তরিত হয়েছে এবং অবধারিতভাবে চাষযোগ্য জমির জন্য বন ধ্বংস হচ্ছে। বনে লেপার্ডের মত যেসব টেরিটোরিয়াল শিকারি প্রাণী রয়েছে তাদের শিকারের জায়গা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হয়ে আসছে। যেসব ছোট প্রাণী শিকার করে জীবন ধারণ করে তাদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সহজ খাবারের লোভে প্রাণীরা লোকালয় আর চাষের জমিতে ঢুকে পড়ছে, বাড়ছে মানুষ-বন্যপ্রাণীর সংঘর্ষ। আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্য স্থানীয়রা করছে বন্য প্রাণী শিকার। এটি সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র সংরক্ষিত বনাঞ্চল যেটি আবার ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড হিসেবে নথিবদ্ধ। শুধু তাই নয়, এই বনের বুক চিড়ে রাস্তা বানানোর কাজও শুরু হয়ে গেছে।
সাদা চোখে স্থানীয় অধিবাসীদের বন উজাড় ও প্রাণী শিকারের জন্য দায়ী মনে হলেও রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারে না । সনাতন পদ্ধতির জুম চাষের বদলে আধুনিক জুম চাষ পদ্ধতিগুলো ব্যবহারে উৎসাহিত করা এবং স্থানীয়দের এর উপকারিতা ও গুরুত্ব বুঝানো যায় তাহলে আর জুমের কারণে নতুন করে বন উজাড় হবে না। পোয়ামুহুরী, কুরুকুপাতা ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে কিন্তু বসবাসরত হাজারো মানুষের জন্য নেই কোন সরকারি হাসপাতাল বা কমিউনিটি ক্লিনিক। পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্বসহ প্রয়োজনীয় সকল স্বাস্থ্যসেবা থেকে এই অঞ্চলের মানুষ বঞ্চিত। স্থানীয়দের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকায় বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব এরা বোঝে না, তাই শিকারের জন্য তাদের এককভাবে দায়ী করা যায় না। বিগত ১০ বছরে এ অঞ্চলে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে বনাঞ্চল প্রায় বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়েছে। থানচি-লিক্রি রাস্তা হওয়ার পর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সুযোগে কাঠ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে যে বনের বাকী গাছগুলো উজাড় হয়ে যাবে সে কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তাই এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে বাস্তাবতার নিরিখে।

এখনো সময় আছে, বন সবটুকু উজাড় হয়ে যায়নি, বনের প্রাণীরাও কোন রকমে এখনো টিকে আছে। ওয়ালি তং পাহাড় আরোহণের সময় আমরা প্রচুর পরিমাণে হরিণ, বন্য গয়াল, ভাল্লুক, বন ছাগলের পায়ের ছাপ পেয়েছি, বন্য প্রাণীর পানি পানের গোপন জায়গা দেখেছি, অনেক আগে স্বাভাবিকভাবে মারা যাওয়া ক্লাউডেড লেপার্ডের মাথার খুলি দেখেছি। এসবই প্রমাণ করে এখনো প্রাণীগুলো টিকে আছে তাদের স্বাভাবিক নিয়মে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে পাড়াগুলোকে মাইগ্রেট করা, বন্য প্রাণী শিকার বন্ধ করা, স্থানীয়দের আমিষ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। স্থানীয়দের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি ও জলবায়ু রক্ষার স্বার্থেই অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি এই বন রক্ষায় একটি যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এখনো এই বনকে বাঁচানো সম্ভব হবে। একটি কার্যকরী নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমেই প্রাণীদের জন্য একটি নিরাপদ অভয়ারণ্য গড়ে তোলা সম্ভব। দরকার শুধু দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছা এবং স্থানীয়দের সহযোগিতা।
একে একে ২০টি দিন কাটিয়ে দিলাম বনে। এই ২০ দিনে বনের সাথে, বনের গাছ, বনের পশুপাখি আর এখানে বাস করা মানুষগুলোর সাথে নাড়ির টান আরো দৃঢ় হয়েছে। আজ যখন ফিরে যাচ্ছি চিরচেনা ইট-পাথরের শহরে তখন শুধু একটাই কামনা এই বন যেন ভালো থাকে, এই বনের প্রাণেরা যেন ভালো থাকে। আবার যখন দেখা হবে এই সবুজের মাতন যেন না কমে।
ফিচার ছবি : লেখক
ছবি : লেখক ও STHN
আস্সলামুআলাইকুম। ভাইয়া আপনি এই বনে কি কি পশু দেখেছিলেন। জানলে খুশি হতাম। ধন্যবাদ।