মানুষ একদিন পর্বত অবরোহণ করবে। সমুদ্র গর্ভে পর্বতের ভিত্তিমূল স্পর্শ করে আসবে। নিজেকে সার্থক বা বিজয়ী ভেবে সুখী হবে। সেটার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত কবে হবে তা জানা নেই তবে সেই সূত্রপাত যেদিন যেখান থেকেই হোক না কেন অবরোহীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকবে ‘মাউন্ট মাওনা কেয়া’। বৈচিত্র আর বিস্ময়ে পূর্ণ এই গ্রহে বহু কিছু আছে যা এখনও ঠিক চর্বিতচর্বণ পর্যায়ের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেনি। যার ফলে বিষয়গুলোর উপর আলোচনা বা যে কোন ধরণের চর্চা এখনও সৌন্দর্যহীন হওয়ার মত ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হয়নি। সরল কথায় লেবুর মত অতি উপকারী খাদ্যবস্তুকে অধিক কচলানোর কারণে তা যেমন পুষ্টিগুণকে পাশ কাটিয়ে ভক্ষণকারীর নিকট বিবেচিত হয় স্রেফ অখাদ্য হিসেবে ঠিক তেমনটি হয়ে ওঠেনি। আসুন না, তেমনই কোন বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক। পৃথিবীর বুকে এমন এক পর্বত আছে যাকে সর্বোচ্চ না বললেও বলা হয় র্দীর্ঘতম বা সবচেয়ে লম্বা। ইংরেজিতে বলা আছে Tallest. কেন সর্বোচ্চ না হয়ে দীর্ঘতম; তার হয়তো যুক্তি নির্ভর ও বিজ্ঞান সম্মত কোন প্রণিধানযোগ্য ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। আপাতত আমরা সে দিকটায় মনোযোগী হচ্ছি না। আজ বরং আমাদের আলোচ্য বিষয় উক্ত পর্বতের বৃত্তান্ত, যাতে করে আমরা যারা বিষয়টি সম্বেন্ধে অবগত নই তারা একটি নতুন বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে পারি আর যাদের আগে থেকেই জানা আছে তাদের ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ ঝালাই হয়ে যেতে পারে।
পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বত ‘মাওনা কেয়া’ (Maona Kea) বা শ্বেত পর্বত। এর অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই কাউন্টিতে। কাউন্টির দ্বীপগুলোর মধ্যে বৃহত্তম দ্বীপটি পাশাপাশি সংযুক্ত পাঁচটি পর্বত যেগুলো কোহালা (Kohola), হুয়ালালাই (Hualalai), মাওনা কেয়া, মাওনা লোয়া (Maona Loa) এবং কিলাউয়ী (Kilaui) দ্বারা গঠিত। দ্বীপটিকে সাধারণত বিগ আইল্যান্ড হিসেবে সম্বোধন করা হয়। পর্বতগুলো প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র আগ্নেয়গিরি। উচ্চতার দিক থেকে এর মাঝে একমাত্র মাওনা লোয়া মাওনা কেয়ার নিকটবর্তী। দুই পর্বতের উচ্চতার ব্যবধান মাত্র ৩৮ মিটার। এই পাঁচ পর্বতের মধ্যে বয়সের দিক থেকে মাওনা কেয়া দ্বিতীয় এবং উচ্চতার দিক থেকে প্রথম । মাউন্ট মাওনা কেয়া হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের সর্বোচ্চ পর্বত হিসেবে স্বীকৃত। মূলত এটা একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। উচ্চতা ১০,২০০ মিটার, যার বেশিভাগ লুকিয়ে আছে পানির নিচে। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরে দৃশ্যমান অবস্থায় আছে ৪,২০৭.৩ মিটার এবং বাকি ৫,৯৯২.৭ মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নিচের দিকে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন প্রতিবেদন মোতাবেক উচ্চতা একেক রকম পাওয়া যায় তাবে তা মাত্র এক থেকে দেড় মিটার কম-বেশি হয়ে থাকে। ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা যায়, মাওনা কেয়ার জন্ম প্রায় এক মিলিয়ন বছর আগে। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে সৃষ্টি হয় এক সুবিশাল ফাটল। সেই ফাটল থেকে এক পর্যায়ে উদগীরণ শুরু হয়। উদগীরণের ফলে লাভা সমষ্টি সমুদ্র গভীরে ধীরে ধীরে পর্বত আকারে গঠিত হতে থাকে। আজ থেকে প্রায় ৫ লাখ বছর পূর্বে পর্বতটি তলদেশ থেকে সমুদ্র বক্ষ বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে উপরে। প্রাথমিক পর্যায়ে এটা ছিল ছোট এবং উত্তপ্ত একটা দ্বীপ। উদগীরণের ফলে আকার ও উচ্চতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে পাশেই অবস্থিত মাউন্ট কোহালা নামে আর এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির সাথে জুড়ে যায় এবং কিছু কালের মধ্যে তাকে গ্রাস করে ফেলে। কোন কোন মতে এর ফলে দৃশ্যমান স্বতন্ত্র অবয়ব থেকে কোহালার বিলুপ্তি ঘটে। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মোতাবেক মাওনা কেয়ার সর্বশেষ উদগীরণ হয়েছিল ৪ থেকে ৬ হাজার বছরের মধ্যবর্তী সময়ে। কিছু সূত্রে খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৪৬০ এর কথা বলা আছে। তবে তার আগে এটা সুপ্তাবস্থায় চলে যায় আজ থেকে প্রায় ২০ কি ২৫ হাজার বছর আগে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় টেকটোনেট প্লেটেটি হাওয়াইন হটস্পটের উপর উঠে যাওয়ার কারণে মাওনা কেয়ার সৃষ্টি। ‘মাওনা কেয়া’ একমাত্র হাওয়াইন আগ্নেয়গিরি যা হিমবাহে আবৃত ছিল। গত ১৮০,০০০ বছরে তিনটি বরফযুগের প্রমাণ পাওয়া যায়। উল্লিখিত বরফযুগে এই পর্বতের চূড়া ব্যাপকভাবে বরফাচ্ছাদিত হয়ে যায়। এখানকার জলবায়ুর অবস্থান গ্রীষ্মমন্ডলীয় বা ট্রপিক্যাল হওয়া সত্বেও বরফযুগগুলোতে তাপমাত্রা কমে আশ্চর্য রকমে আগ্নেয়গিরির শীর্ষে আইসক্যাপ গঠনের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে তা আবারও লাভায় আচ্ছাদিত হয়ে যায়। নিকট অতীতে হিমবাহের ব্যাপ্তি শীর্ষদেশ হতে নিচের দিকে ৩২০০ থেকে ৩৮০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৯৭৪ সালে এক সমীক্ষা চলাকালে শীর্ষদেশের ভূমিতলে কমপক্ষে ২৫ মিটার এলাকা জুড়ে একটি চিরহিমায়ীত অঞ্চল পাওয়া গিয়েছিল সম্ভবত তা আজও বিদ্যমান।
মাওনা কেয়ার দৃশ্যমান কোন শৃঙ্গ নেই কিন্তু কিছু ছোট ছোট চূড়া আছে। ধারণা করা হয়, সুদূর অতীতে সুনির্দিষ্ট একটি শৃঙ্গ বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে উদগীরণে ফলে তা পর্বত গর্ভে ঢুকে যায় বা বিলীন হয়ে যায়। উল্লেখ্য, উচ্চতা জনিত ওজন ও চাপের দরুণ মাওনা কেয়া প্রতিবছর দশমিক ২ মিলিমিটার করে চ্যাপ্টা/ স্ফীত হয়ে যাচ্ছে। সুপ্তাবস্থা বিদ্যমান থাকলেও মাওনা কেয়ার উদগীরণ আবারও হবে বলে ধারণা করা হয় এবং তা দীর্ঘকাল ধরে চলমান থাকবে। সর্বশেষ উদগীরণে ভিত্তিতে ধারণা করা হয় পর্বতের শীর্ষ দেশ যেহেতু বৃহৎ এক সমতল এলাকা সেহেতু এর উদগীরণের সূত্রপাত উপরিভাগের যে কোনো জায়গা থেকে হতে পারে এবং দীর্ঘ লাভার স্রোত তৈরি করবে যা ১৫ থেকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। অগ্নুৎপাতের কাল বা স্থায়ীত্ব দীর্ঘ হওয়ার ফলে উদগীরণের উৎসস্থলে একটি সুউঁচ্চ শৃঙ্গ তৈরি হতে পারে। যদিও আগামী কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এটা ঘটার সম্ভাবনা নেই।
হাওয়াইয়ের ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা স্থানীয় বাস্তুসংস্থানকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। প্রত্যন্ত এই দ্বীপে এমন কিছু প্রজাতির জীব আছে যা অন্য কোথাও নেই। দূরবর্তী হওয়ার ফলে এখানকার প্রজাতিগুলো আক্রমণাত্মক প্রজাতি থেকে সুরক্ষিত ছিল। অথচ সেই হাওয়াই এর প্রকৃতি আজ হুমকির মুখে। হাওয়াই দ্বীপে প্রাথমিক বসতি স্থাপন এখানকার বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানব বসতির বিকাশ ও কৃষি বিস্তারের কারণে ব্যাপকহারে জমি পরিস্কার করা হয়। প্রাচীন হাওয়াইনরা বাহির থেকে গাছ ও প্রাণীর বিভিন্ন প্রজাতি বয়ে আনে যা স্থানীয় প্রজাতি বিলুপ্তির প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করে। বনজঙ্গল আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে নিম্নাঞ্চলের বনাঞ্চল পরিণত হতে থাকে তৃণভূমিতে। এখানকার প্রাচীন অধিবাসী মাওনা কেয়ার ঢালু অঞ্চলে বাস করতো। তখন খাবার ও পানি প্রচুর ছিল। দেখা যায় ১২ শতকের প্রারম্ভে তাদের বসবাস মাওনা কেয়ার সমুদ্র উপকূলীয় নিম্নভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বলে এই এলাকা শিকার, মূল্যবান পাথর সংগ্রহ, আধ্যাত্মিক কারণ এবং সম্ভবত জ্যোতির্বিদ্যা ও নেভিগেশন বা নৌচালনা বিষয়ক পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। এখানকার বনজঙ্গল, প্রাণী ও খাদ্যের প্রাচুর্যতা এবং পারিপার্শ্বিকতা বসবাসের জন্য উপযুক্ত। আশ্রয় নির্মাণের জন্য উপকরণও ছিল পর্যাপ্ত।
১১ শতকে স্থানীয়রা হাতিয়ার নির্মাণের জন্য পর্বতের উঁচুতে আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে বিশেষ শিলা সংগ্রহ করতো, যার মধ্যে গ্যাবরো (Gabbro) নামক কালো দানাদার ও প্লুটনিক পাথরও ছিল। মাছ ধরার যন্ত্রাদি ও ব্লেড তৈরির জন্য গ্যাবরো ছিল উপযুক্ত পাথর। ১৪ শতকের পর মসৃণ কাটিং এর জন্য সেই উচ্চতায় কারখানার মত স্থাপনা তৈরি হয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় বেসিনের সর্বোচ্চ সরোবরের অবস্থান এই মাওনা কেয়া পর্বতে। ওয়াইয়াউ (Waiau) নামের সরোবরটি দ্বীপের একমাত্র পার্বত্য জলাশয়। এর আয়তন মাত্র ১.৮০ একর আর গভীরতা প্রায় ৩ মিটার। এই সরোবর ওয়ার্কশপের শ্রমিকদের পানির যোগান দিত। পৌরাণিক কাহিনী মতে খোদ পর্বতের জন্য শক্তি প্রার্থনা করা ছিল তাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস চর্চার একটি উপলক্ষ্য। সে লক্ষ্যে সমাজপতিগণ সদ্য জন্মগ্রহণ করা শিশুর কর্তনকৃত নাভি সরোবরের পানিতে ডুবিয়ে দিত। শ্রমিকরা তাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস থেকে কল্পিত দেব-দেবীর মাজারও তৈরি করতো। এই বিশেষ নিদর্শনগুলো মাওনা কেয়ার বরফের নিচে এখনও সংরক্ষিত আছে। ১২ থেকে ১৮ শতকে স্থানীয় সংস্কৃতি সম্প্রসারণের স্বার্থে প্রথম যুগের এই বিষয়গুলো মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে অনুসরণ করা হতো । অর্থাৎ সর্বোচ্চ পর্বত হওয়ার সুবাদে মাওনা কেয়া আদি হাওয়াইনদের কাছে শক্তিশালী সংস্কৃতিক তাৎপর্যের ভূমিকা রাখে।
হাওয়াইন পৌরাণিক কাহিনী মতে দ্বীপের পাঁচটি শিখরকেই পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। মাওনা কেয়ার শীর্ষ স্থানটি সবচেয়ে বেশি পবিত্র। এই কারণে পর্যটক বা দশনার্থীদের প্রবেশাধিকার প্রাচীন হাওয়াইন আইন ‘কাপু’ (Kapu) দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকতো। তারা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে নির্দিষ্ট দেব-দেবীর সাথে যুক্ত করেছিল। কাহিনীতে মাওনা কেয়ার শীর্ষদেশকে দেবতার অঞ্চল হিসেবে দেখা যায়। সেখানে হিতৈশী আত্মাদের বসবাস। এদের মধ্যে তুষার দেবতাও ছিল। প্রধান পুরোহিত ব্যতীত আরোহণ ছিল নিষিদ্ধ। প্রাক যোগাযোগের কালে স্থানীয়রা মাউন্ট মাওনা কেয়ার শীর্ষে আরোহণ করতো বলে ধারণা করা হয়। তবে আরোহণের সুনির্দিষ্ট কোন পথ বা ট্রেইল ছিল না। গবেষণায় সেই সময়ের কোন পথের নিশানা বা প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে তারা পানির উৎস অনুসরণ করে অথবা শৈলশিরা ধরে আরোহণ করতো। তাদের দেব-দেবীর স্মরণে নির্মিত পবিত্র স্থাপনাগুলো ছিল সামিটের কাছাকাছি ঢালুতে। অধিবাসীদের মাঝ থেকে অনেকেই পবিত্র স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত থাকতো। তাদের সাথে দেখা করার জন্য পরিবারের সদস্যরা কেউ কেউ সে এলাকায় যেতো। মাওনা কেয়া আরোহণ সম্পর্কিত এই ঐতিহ্য আজও বিদ্যমান। সেখানে কাপু বলবৎ থাকার কারণে তাদের মাঝ থেকে নগন্য সংখ্যক লোকই শীর্ষ দেশে গিয়েছিল।
প্রামাণিক দলিল মতে ২৬ আগস্ট, ১৮২৩ সালে আমেরিকান ধর্মপ্রচারক যোসেফ এফ. গুডরিচ প্রথম ব্যক্তি যিনি মাওনা কেয়া শীর্ষে আরোহণ করেন। আরোহণের পর তিনি সেখানে কিছু সংখ্যক পাথরের ছোট্ট একটি বিন্যাস দেখে বলেন, শীর্ষ দেশে আরোহণকারী হিসেবে তিনি প্রথম মানব নন। তিনি ওয়াইয়াউ লেকও পরিদর্শন করেন। উল্লেখ্য, গোড়া থেকে সামিট পর্যন্ত তিনি চার ধরনের বাস্তুসংস্থান লক্ষ্য করেন। পরবর্তীতে অবশ্য বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অভিযান অথবা গবেষণার কল্যাণে বিষয়টি বিস্তারিত জানা যায়। যেমন- ১৮৩৪ সালের জানুয়ারিতে ডেভিড ডগলাস নামের একজন এই পর্বতে আরোহণ করেন। তিনি উচ্চতা দ্বারা বিভাজিত এখানকার বৃক্ষ প্রজাতির বিষদ বর্ণনা করেন। দুঃখের বিষয় দ্বিতীয়বার তিনি একই বছরের জুলাইয়ে অভিযান চালান এবং মৃত্যু বরণ করেন। পরবর্তীতে অবশ্য সেই ‘কা লুয়া কাউকা’ (ka Lua Kauka) নামক এলাকার গাছগুলোকে তার স্মরণে ‘ডগলাস ফার ট্রি’ হিসেবে নামকরণ কার হয়। যাহোক, গুডরিচ-এর পর ১৭ই জুন, ১৮২৫ সালে আমেরিকান উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ জেমস ম্যাকরে এর নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ অভিযান চালায় এবং শীর্ষ দেশে আরোহণ করতে সক্ষম হয় । ম্যাকরে হলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি এখানকার বিশেষ উদ্ভিদ ‘মাওনা কেয়া সিলভারসোর্ড’ (Maona Kea Silversowrd) এর কথা রেকর্ড করেন। সিলভারসোর্ড এমন এক উদ্ভিদ প্রজাতি যার পাতাগুলো তলোয়ারের মত লম্বাটে আর রং রুপালি। শুধুমাত্র এই গাছ প্রত্যক্ষ করার জন্যই তাদের সেখানে আরোহণ করা। ম্যাকরে উল্লেখ করেন, পর্বতের সর্বশেষ এক মাইল এলাকায় এই গাছ দেখা যায় এবং সিলভারসোর্ড ছাড়া সেখানে অন্য কোন গাছের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। মাওনা কেয়ার আরোহণ নিয়ে একটি চমকপ্রদ ঘটনাও আছে, ১৮৮১ সালে রাণী এমা হাওয়াইন রাজতন্ত্রের প্রধান প্রশাসক হওয়ার প্রতিযোগিতায় ওয়াইয়াউ লেকের পানিতে স্নানের জন্য শীর্ষে যাত্রা করেছিলেন। মাওনা কেয়ায় আরোহণের ইতিহাসে তো একবার এক দারুণ ঘটনা ঘটে গেল। ৬ আগস্ট, ১৮৮৯ ই. ডি. বাল্ডউইন নামের এক লোক গবাদী পশুর ট্রেইল অনসরণ করেই উপরে চলে যান। ১৯ শতকের শেষে অথবা ২০ শতকের প্রারম্ভে মাওনা কেয়ায় আরোহণের ট্রেইল তৈরি হয় যাতে ঘোড়ায় চড়ে আরোহণ করা যেত। ১৯৬৪ সালে আরোহণের পাকা রাস্তা নির্মাণের আগ পর্যন্ত যানবাহন চলাচলের কথা কল্পনাই করা যেতো না। বর্তমানে আরোহণের একাধিক ট্রেইল আছে। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৭ সাল নাগাদ প্রতি বছর এক লাখের মত পর্যটক জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত তথ্য নিতে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা তথ্য কেন্দ্র ভ্রমণ করেছে। বর্তমানে প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ হাজার পর্বত আরোহী ও পর্যটক মাওনা কেয়ায় আরোহণ করে।
মাওনা কেয়া এবং অত্র এলাকার স্থানীয় বৃক্ষরাজি, কীটপতঙ্গ দ্বারা সমৃদ্ধ আলপাইন বাস্ততন্ত্র ছিল অদ্বিতীয়। ১৫০০ সালের দিকে যখন পলিনেশিয়ানদের আগমন ঘটে তখন তারা সাথে করে নতুন গাছ ও প্রাণী নিয়ে আসে, যা আসলে দ্বীপের প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। এখানে ইউরোপীয়ানদের আগমন ঘটে ১৮ শতকের শেষের দিকে। তারা তাদের নানা কর্মকাণ্ডের দ্বারা স্থানীয় পরিবেশের ক্ষতি সাধন করতে থাকে। চিনি শিল্প গড়ে তোলার স্বার্থে নিম্নাঞ্চলের সমতল বনভূমি ধ্বংস করে ফেলে। তাদের আগমন দ্বীপের বাস্তুতন্ত্রের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে। গরু, ঘোড়া, ছাগল ও অন্যান্য গবাদি পশু চড়ানোর জন্য পাহাড়ের বহু বনাঞ্চলকে চারণভূমিতে পরিণত করে ফেলে। ১৯ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানরা আরও বসতি স্থাপনকারী বা সেটেলারদের এখানে আনে, নিঃস্বন্দেহে যার নেতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব ছিল। পর্বতের নিচের দিকে নির্বিচারে বন ধ্বংস করে কৃষি জমিতে রূপান্তরিত করা হয়। এতে পশুপাখি ব্যাপকহারে অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
মাওনা কেয়া চূড়ার বেশিভাগ অংশ লাভা এবং বৃক্ষশূন্য তুন্দ্রা বিশেষ একটি জায়গা। গাছপালার পক্ষে এটা উপযোগী নয়। এটা মূলত হাওয়াইন গ্রীষ্মমন্ডলীয় উঁচু গুল্মভূমি হিসেবে পরিচিত। অত্যাধিক ঠান্ডা আবহাওয়া, অল্প বৃষ্টি এবং প্রচুর তুষারপাতের কারণে যে কোন বৃক্ষ প্রজাতির বেড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া মাটির স্বল্পতা শিকড় বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে যার ফলে গাছ মাটি থেকে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে না। অধিকন্তু, এই ভূমির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা খুবই কম। উদ্ভিদের মধ্যে সিলভারসোর্ড ছাড়াও এখানে আছে আহিনাহিনা (Ahinahina), হাওয়াইন স্ট্রবেরি, আলপাইন টেট্রামলোপিয়াম (Tetramolopium) প্রভৃতি। ঘাসের প্রজাতিগুলো হলো আলপাইন হাইয়ারগ্রাস, পিলি উকা (Pili Uka)। পর্বতের শীর্ষ দেশ এলাকায় শৈবাল আছে প্রায় ২১ প্রজাতির যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই স্থানীয় প্রজাতির। এছাড়াও সম্পূর্ণ এলাকায় হাওয়াইন ফার্নের কিছু প্রজাতির দেখা মেলে। এখানকার বিশেষ প্রজাতি সিলভারসোর্ড অত্যান্ত বিপন্ন একটি প্রজাতি যা মাওনা কেয়ার সুউচ্চ সিন্ডার মরুভূমির শ্রী বৃদ্ধি করে রাখে।
মাওনা কেয়ার সর্বোচ্চ বন ২ থেকে ৩ হাজার মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত। এই বনে স্থানীয় প্রজাতির উদ্ভিদ ম্যামেন (Mamane) এবং ন্যাইও (Naio) এর আধিপত্য বিরাজমান। যার কারণে এই বন ম্যামেন-ন্যাইও বন বলে পরিচিত। ম্যামেন বিচি ও ন্যাইও ফল এখানকার পাখিদের প্রধান খাবার। এমন আর একটি ফল পালিলা (Palila) সাধারণত পর্বতের ঢালে যার দেখা মিলতো। বিশেষ করে মাওনা কেয়া, মাওনা লোয়া এবং হুয়ালালাই এর ঢালে। বর্তমানে শুধু মাওনা কেয়াতেই পাওয়া যায়। ইতোমধ্যেই এটা বিপন্ন প্রায় তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এখানকার উঁচু পরিবেশে অল্প কিছু প্রাণীর প্রজাতি টিকে থাকতে পারে। মাওনা কেয়ায় মাকড়সা সহ বেশ কিছু কীটপতঙ্গ, পাখি ও বাদুর দেখা যায়। পাখির মধ্যে আমাকিহি (Amakihi), এপাপেন (Apapane) এবং এলিপাইও (Elepaio) অন্যতম। এরা সাধারণত পোকামাকড় আর বিভিন্ন ফলের বিচি খেয়ে জীবন ধারণ করে। ১৯৫০ এর দশকে এখান থেকে পশুপাখি প্রায় নির্মুল হয়ে গিয়েছিল এবং সংখ্যা কমে মাত্র কয়েকশতে নেমে এসেছিল। ১৯৫৯ সালে ‘হাওয়াই ডিপার্টমেন্ট অব ল্যান্ড অ্যান্ড ন্যাশনাল রিসোর্সেস’ দ্বীপের সংরক্ষণ ও ভূমি ব্যবহার ব্যবস্থাপনা ও টেকসই নিয়ন্ত্রণের নীতি পরিবর্তন করে। ফলোশ্রুতিতে এখানকার প্রকৃতি শেষ রক্ষা পায়।
মাউন্ট মাওনা কেয়ার অবস্থান নিরক্ষীয় অঞ্চলের নিকটবর্তী হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্টসহ বিভিন্ন দেশ মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য এই পর্বতকে বেছে নিয়েছে। নগর-বন্দরের কৃত্রিম আলোর অনভিপ্রেত বাধা না থাকা, তুলনামূলক কম আদ্রতাপূর্ণ আবহাওয়া, পরিস্কার আকাশ, সর্বোপরি প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত হওয়া এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের অনেক উপরে থাকার কারণে খুব নিখুঁতভাবে টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশ দর্শন করা যায়। বর্তমানে মাওনা কেয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র। জগতের নামকরা সব মহাকাশ গবেষণা সংস্থা এখানে টেলিস্কোপ স্থাপন করেছে। বর্তমানে এখানে এগারোটি দেশের মোট ১৩টি টেলিস্কোপ আছে। ১৯৬৫ সালে মাওনা কেয়ার শীর্ষদেশের বড় একটি অংশ ‘ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই’কে ইজারা দেয়া হয়। বহু জটিলতার অবসান এবং অনেক কষ্টের পর ১৯৭০ সালে মাওনা কেয়ার শীর্ষে স্থাপিত হয় প্রথম টেলিস্কোপ যন্ত্র। টেলিস্কোপ স্থাপনের জন্য অর্থায়ন করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রায় ১২টি দেশ। স্থানীয় পৌরাণিক বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন স্বরূপ টেলিস্কোপগুলো স্থাপিত হয় মূল শীর্ষবিন্দু থেকে বেশ কয়েক গজ দূরে। সারা বিশ্বের জ্যোতির্বিদদের জন্য এটা স্বপ্নের জায়গা হিসেবে বিবেচিত হয়।
মাওনা কেয়ার শীর্ষ দেশে আলপাইন আবহাওয়া বিরাজ করে। ক্রান্তীয় অক্ষাংশের প্রভাবে তাপমাত্রার পরিবর্তন খুব কম হয়। মার্চ মাসে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রীতে নেমে আসে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ৩৭০০ মিটার উপরের এলাকা তুষারে ঢেকে থাকে, যার পুরুত্ব কয়েক ইঞ্চি থেকে কয়েক ফুট হয়। আবার কখনও কখনও অক্টোবর থেকে এপ্রিল বা মে মাসের মধ্যবর্তী সময়ে ৩৪০০ থেকে ৩৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এলাকায় যে কোন সময়ই তুষারপাতের সম্ভাবনা থাকে। গ্রীষ্মকালেও তুষারপাত হয়। শীর্ষ দেশে বাতাসের বেগ ১২০ মাইল পর্যন্ত উঠা অতি সাধারণ ব্যাপার। সামিটে অক্সিজেনের মাত্রা সমুদ্র সমতলের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম থাকে।
মাউন্ট মাওনা কেয়ায় যাওয়ার উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল। মাওনা কেয়া পৃথিবীর একমাত্র পর্বত চূড়া যেখানে সমুদ্রতল থেকে ৪২০৭.৩ মিটার উঁচুতে গাড়ি চালিয়ে আরোহণ করা যায়। শীর্ষ দেশ পর্যন্ত উন্নত পাকা সড়ক আছে। গাড়ি রিজার্ভ করে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। ছুটির দিনগুলোতে ভ্রমণ পরিবেশক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে ক্যারাভানে করে মাওনা কেয়া ভ্রমণের বিশেষ অফার থাকে। ক্যারাভানে করে দলবলসহ বা অন্য কোন দলের সাথে যুক্ত হয়ে যাত্রা করা যায়। যাত্রাপথে তথ্যকেন্দ্রে একটা ফরম পূরণ করতে হবে। তথ্যকেন্দ্রের অবস্থান সমুদ্র সমতল থেকে ৯২০০ ফুট উপরে। যাদের পায়ে হেঁটে অর্থাৎ ট্রেকিং করে যাওয়ার ইচ্ছা তাদেরকে তথ্যকেন্দ্র থেকে শুরু করতে হবে। কারণ, পর্বতের একেবারে গোড়া থেকে ট্রেকিং এর কোন ব্যবস্থা নেই। তথ্যকেন্দ্র থেকে শীর্ষ বিন্দু যাওয়া এবং আসায় ৮ থেকে ১০ ঘন্টা সময় লাগে। পথের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। যাত্রাপথে ০ থেকে ৮ ডিগ্রী তাপমাত্রার মুখোমুখি হওয়ার মত পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। শীর্ষ বিন্দু পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হলেও চাইলে কোন আরোহী সেখানে যেতে পারে এবং স্পর্শ করে আসতে পারে স্বপ্নের তীর্থবিন্দু। এই হল মাওনা কেয়া আরোহণের টুকটাক খবরাদী। আর অবরোহণের খবরাদী আপাদত অপেক্ষমান বলে গণ্য হোক। পর্বতারোহণের মতো পর্বত অবরোহণের দুঃসাহসিক অভিযানের যাত্রা শুরু হবে সেই প্রত্যাশা রইল।
ছবি : Vanessa Fortier, Doug Keown, আন্তর্জাল।
তথ্যসূত্র:
- Molecular Genetic Consequences of a Population Bottleneck Associated with Reintroduction of the Mauna Kea Silversword : Society for Conservation Biology
- Maona Kea: Stargaze from the Sacred White-Capped Mountain: Katie Young Yamaraka
- Maona Kea Temple under Siege
- Evaluation of Maona Kea, Hawaii, as an Observatory Site: Publication of the Astronomical Society of the Pacific
- The Geologic History and Landscape of Maona Kea: National Geographic Society
- Maona Kea: Hawaii Center for Volcanology
- The Fascinating History of Maona Kea- The Mountain Behind the Controversy: South Kohala Management
- The Long Trail of Hawaiin Hotspot
- United States Geological Survey
- Restore Maona Kea: Maona Kea Forest Restoration Project (MKFRP). Hawaii.Gov
- The Planet Ecology of Maona Kea, Hawaii- Coxtence F. Hartt and Marie C. Neal
- Life in Maona Kea’s Alpine Desert- Mike Rechardson
- Maona KeaVolcano: Volcano Discovery