২৩ জানুয়ারি ২০১৯ পর্বতারোহণের ইতিহাসে একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। ৫ জন বলিভিয়ান নারী দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ অ্যাঙ্কানগুয়া (Aconcagua) আরোহণ করেন। এশিয়ার বাহিরে উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ হচ্ছে অ্যাঙ্কানগুয়া। গল্পটা এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলে সাদামাটাই থেকে যেতো। কিন্তু এই গল্পের শিকড় যেমন গভীর থেকে গভীরে প্রোথিত তেমনি কেবল পর্বত জয় নয়, একটি জাতি-গোষ্ঠীর, একটি সংস্কৃতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের গল্প। তারচেয়েও বড় কথা এক দল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার গল্প।
হুয়ানা পোটোসি (Huayna Potosi) বলিভীয়ার একটি পর্বত। যা রাজধানী লা’পাজ হতে আনুমানিক ২৫ কিমি উত্তরের কর্ডিলিরা রিয়েল (Cordillera Real) পর্বত রেঞ্জে অবস্থিত। পর্বতটি পর্বতারোহীদের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। আর এখানেই পোর্টার ও পর্বতারোহীদের ক্যাম্পগুলোতে রান্নার কাজ করে জীবনের অধিকাংশ দিন কেটে যাচ্ছিল Aymara আদিবাসী নারীদের। দীর্ঘদিন পর্বতারোহীদের হেঁশেলে রান্না করা সেই সব নারীদের ১১ জন ২০১৪ সালে নিয়ে ছিলেন ব্যতিক্রমী এক পদক্ষেপ। রান্নার পাত্র, জলন্ত উনুন পাশে রেখে পায়ে পরে ছিলেন ক্র্যাম্পন(Crampon) আর ঐতিহ্যবাহী বোলার টুপি খুলে মাথায় পরে ছিলেন হেলমেট । তাঁদের প্রথাগত পোষাক পরিচ্ছদ পরেই আরোহণ করেছেন আন্দিজ পর্বতামালার পর্বতগুলো। আর নিন্দুকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হয়ে উঠেছিলেন পর্বতারোহী।
আইমার(Aymara) নারীগণ নিজেদের Cholita Climber বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। Cholita শব্দটা স্পেনিশ শব্দ Cholo বা Chola হতে এসেছে। যা সাধারণত সংকর রেড ইন্ডিয়ান জাত বুঝায়। শব্দটি এক সময় অসম্মাজনক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু আইমারা নারীগণ এই শব্দটিই বেছে নিয়েছেন নিজেদের জন্য। আর আজ শব্দটি তার নেতিবাচক অর্থ ঝেড়ে ফেলে স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

ঐতিহ্য ও প্রথাগত বর্ণিল পোশাকের সাথে পর্বতারোহণের গেজেট দ্বারা সজ্জিত হয়েই আরোহণ করেন পশ্চিম ও দক্ষিণ গোলার্ধের উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ অ্যাঙ্কানগুয়া (Aconcagua) । আরোহণ করতে সময় নেন সাত দিন। ভাবতেই অবাক লাগে যারা কিছু দিন আগেও পর্বতারোহীদের রান্না ও সেবকের কাজ করতেন তাঁরাই হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর পর্বতারোহী। শুধু কি তাই- এদের ভিতর অনেকেই আছেন যাদের বয়স পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব। পোলিরাস (polleras) নামে বর্ণিল পোষাক (লং স্কার্ট) পরিধান করে পর্বতারোহণের কথা ভাবাই যায় না। কিন্তু তাঁরা সেটা করে দেখিয়েছেন। তাদের বর্ণনায় জানা যায়, কখনও কখনও ক্র্যাম্পনের সূচালো স্পাইকে তাদের লং স্কার্টের প্রান্ত আটকে যেতো। কিন্তু তাঁরা এসবের তোয়াক্কা না করেই জয় করেন এশিয়ার বাহিরে অবস্থিত সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গটি।
আইমার(Aymara) নারীরা সামাজিক ও জাতিগত বৈষম্যের শিকার। কয়েক দশক আগেও তাদের কিছু কিছু রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে দেয়া হতো না। তাঁরা কোন টেক্সি চড়তে পারতো না। এমনকি গণ পরিবহন বাসেও চলাচল করতেও দেয়া হতো না। অনেক প্রজন্ম ধরে তাদের রাজধানী লা পাজের কেন্দ্রীয় স্কয়ারে, প্লাজা মুরিলো (Plaza Murillo) – রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে বা শহরের জোনা সুরের (Zona Sur ) মতো অভিজাত এলাকাগুলোতে চলাফেরার অনুমতি ছিল না। “একটা সময় ভাবাই যেতো না একজন Chola আইনজীবী বা সাংবাদিক হবেন অথবা টেলিভিশনের ক্যামেরায় কথা বলবেন তাও আবার জাতীয় ইস্যু নিয়ে ” বলছিলেন Maria Isabel Cordova যিনি আইমারা জাতিগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করছেন রাজধানী লা’পাজে। আশার কথা হচ্ছে সেই চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। বলিভিয়ান সমাজে একজন নারী পর্বতারোহণের মতো কষ্টকর ও চ্যালেঞ্জিং কাজ করবে তা ভাবতেই পারতো না সে সমাজের পুরুষেরা। তারা ধরেই নিতো শারীরিকভাবেই নারীরা পর্বতারোহণের জন্য অক্ষম। আজ পুরুষের পাশাপাশি পেশীবহুল আরও নানা কাজে তাঁরা অংশগ্রহণ করছেন। খেলছেন মুষ্টিযুদ্ধ। সর্বশেষ পর্বতারোহী হয়ে চমকে দিলেন গোটা বিশ্বকেই।
আন্দিজ পর্বতমালায় আইমার(Aymara) জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রায় হাজার বছর ধরে বাস করছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা মতে আইমার(Aymara) দের নিজস্ব পোশাক ও ভাষা এবং সংস্কৃতি প্রমাণ করে যে, তাঁরা হয়তো এ অঞ্চলের আরও পুরোনো আদিবাসী হয়ে থাকবেন। বর্তমানে পেরু, বলিভিয়া ও চিলিতে প্রায় এক মিলিয়ন আইমার(Aymara) জনগোষ্ঠীর আদিবাসী রয়েছেন। তাঁরা মূলত আন্দিজ এবং আলটিপ্লানো (Altiplano) অঞ্চলে থাকেন। কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিকের ধারণা প্রায় ৫০০০ বছর ধরে তারা আন্দিজের বাসিন্দা। তবে এটা নিশ্চিত বলা যায় যে, আইমার(Aymara) জনগোষ্ঠীর মানুষ কোন প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই আজও টিকে আছেন। যদিও গবেষকদের মাঝে আইমার(Aymara)দের Origin নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। আজকের দিনে যে অঞ্চলে তাদের দেখা যায় সেটা Tiwanaku। জায়গাটি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান যা পশ্চিম বলিভিয়ার টিটিকাকা হ্রদের কাছে অবস্থিত। এই জায়গাটি ইনকাদের দ্বারা ১৫ শতকে আক্রান্ত হয় এবং ইনকারা বিজয়ী হলেও আইমার(Aymara) ইনকা সাম্রাজ্যের অধীনেই কিছুটা স্বায়ত্তশাসন ধরে রেখেছিল। পরবর্তীতে স্প্যানিশদের আগমনে এই জায়গাটি স্পেনের উপনিবেশিক অঞ্চলে পরিণত হয়। আইমার (Aymara) সংস্কৃতিতে ইনকা সভ্যতার প্রভাব থাকলেও তারা নিজের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করতে পেরেছিল কিন্তু স্প্যানিশদের ক্ষেত্রে তা হয় নি। আইমার সংস্কৃতিতে তাই স্প্যানিশ প্রভাব বেশ লক্ষণীয়।

কেন পর্বতে উঠার কথা ভাবলেন? এরকম প্রশ্নের উত্তরে Lidia Huayllas Estrada (গ্রুপের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক) বলেছিলেন, “ আমি দীর্ঘদিন ধরে রান্নাই করে গেছি। মাঝে মাঝে ভেবেছি আমিও পর্বতের উপরে যেতে চাই। কারণ আমি জানতে চাইতাম ঐখানে (পর্বত শিখরে) পৌঁছালে কেমন অনুভূতি হয়।” Estrada তাঁর স্বামীকে একদিন জিজ্ঞাসা করেন, “পর্বত শৃঙ্গ আরোহণ করলে কেমন লাগে?” উত্তরে স্বামী বলেছিলেন, “তুমি নিজেই একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো”
প্রথমে শুরু করা সেই ১১ জন নারীর প্রায় সকলের স্বামীই ছিলেন আন্দিজের গাইড অথবা পোর্টার। সেই ১১ জনের বয়স ছিল ৪২ থেকে ৫০ বছর। তাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না। কিন্তু প্রথম অভিযানে Huayna Potosí পর্বত আরোহণ থেকে তারা অনেক কিছুই শিখতে পেরেছিলেন। আর ক্যাম্পে আসা দক্ষ পর্বতারোহীদের দেখে দেখে তাঁরা অনেক কিছুই রপ্ত করেছিলেন। সর্বোপরি আত্মবিশ্বাস ও নিজেদের প্রতি ছিল তাঁদের অগাধ শ্রদ্ধা ও ভরসা। তাই তো সেই ১১ জন তাঁদের প্রথম অভিযানেই পাড়ি দিয়েছেন ১৯,৯৭৪ ফিট উলম্ব পথ এবং স্পর্শ করেছেন Huayna Potosí পর্বত শিখর।
নিজেদের উপযুক্ততা ও আয়ত্ত করা কৌশলগুলোর চর্চা রাখার জন্য পর্বতারোহণের সিজনে ২ সপ্তাহে অন্তত একবার তাঁরা পর্বতারোহণ করে থাকেন। কিন্তু স্বল্প আয়ের এই প্রান্তিক নারীগণের পক্ষে সবসময় গেজেট গিয়ার ক্রয় করার পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না। তাছাড়া আন্দিজ পর্বতমালার সেই কঠিন পরিবেশে পর্বতারোহণের সরঞ্জামাদি সংগ্রহ ও পরিবহন করে ক্যাম্প পর্যন্ত নেয়া বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। তাই তাঁরা গেজেটগুলো ভাড়ায় নিয়ে ব্যবহার করে থাকেন এবং তাঁদের সঞ্চিত অর্থ হতে তার ব্যয় বহন করেন।
যখন প্রথম শুরু করেছিলেন তখন তাদের লক্ষ্য ছিল Huayna Potosí পর্বত । তারপর তাঁদের লক্ষ্য দাঁড়ায় দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত। এর মাঝে একে একে জয় করেন Huayna Potosí, Illimani, Acotango, Pomarape, Parinacota যার ভিতর বলিভীয়ার সর্বোচ্চ পর্বত Nevada Sajama রয়েছে। সেই ১১ জনের একজন Dora Magueño এর ভাষ্যমতে, “যখন আমি (Huayna Potosí) আরোহণ করি তখন আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।… আমি এখনও শক্ত সমর্থ, আমি পর্বতারোহণ চালিয়ে যাবো।” Dora এর বয়স এখন ৫০ কিন্তু তাঁর মনোবল সেই দুরন্ত তরুণীর মতই। যে পাঁচজন অ্যাঙ্কানগুয়া (Aconcagua) পর্বতের শীর্ষে আরোহণ করেছেন তাঁরা হলেন- Lidia Huayllas, Dora Magueño, Analía Gonzáles, Elena Quispe and Cecilia Llusco । হয়তো সেই দিন দূরে নয় ঐতিহ্যবাহী Polleras স্কার্ট আর প্রথাগত পোশাক পরেই এভারেস্টের পথে হাঁটবেন Cholita Climber দের উত্তরসূরিগণ।
Cholita Climber নিয়ে একটি ছোট ডকুমেন্টারি রয়েছে- The Cholita Climbers of Bolivia Scale Mountains in Skirts.
https://www.youtube.com/watch?v=hGxxvefRk9A&feature=youtu.be
তথ্য সূত্র : David Mercado / Reuters, The Guardian, Owen Clarke/Rock and ice, Justin Housman/ Adventure-journal, BBC
ফিচার ছবি : Screenshot from The Cholita Climbers of Bolivia Scale Mountains in Skirts.
Great content! Super high-quality! Keep it up! 🙂
ধন্যবাদ