পৃথিবীর প্রতিটি দেশে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ থাকে, যা সেই দেশের সমাজ, সংস্কৃতি তথা অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে কয়টি প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে হালদা নদী তার মধ্যে অন্যতম। জীববৈচিত্র ও মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ হালদা একদিকে যেমন মৎস্য খাতে অবদান রাখছে তেমনি সুদীর্ঘ কাল ধরে অবদান রেখে চলেছে জাতীয় অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের খাগড়াছড়ি জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশের বদনাতলী পাহাড়মালা হালদা নদীর উৎপত্তিস্থল। জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম সদর, হাটহাজারী, রাউজান উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সবশেষে কালুরঘাট এলাকায় এসে কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে। কর্ণফুলীর সাথে মিলিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত জোয়ার-ভাটা খেলা করে। আর এই বিষয়টি হালদাকে জীববৈচিত্রে ভরপুর করে তুলেছে। এর মোট দৈর্ঘ্য ৮০.৪৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে নাজিরহাট পর্যন্ত ২৮.৯৯৬ কিলোমিটার সারা বছরই বড় নৌকা পরিবহণের উপযোগী থাকে। ছোট নৌকাগুলো আরও ২০-২৫ কিলোমিটার ভেতরে অর্থাৎ নারায়ণহাটা পর্যন্ত চলাচল করতে পারে। কাঠ, বাঁশ, ছন প্রভৃতি বনজ সম্পদ রামগড়ের দক্ষিণাঞ্চল ও বিভিন্ন এলাকা থেকে হালদার বুক দিয়ে ভাসিয়ে আনা হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীর পণ্যসামগ্রীর প্রায় অধিকাংশ হালদা নদীপথে বড় মালবাহী নৌকায় করে পরিবহণ করা হয়। রুই, কাতলা, মৃগেল এবং কালিবাউস অর্থাৎ দেশী কার্প জাতীয় মাছ এবং চিংড়ি এ নদীতে ডিম ছাড়ে। সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম হালদার অর্থনৈতিক গুরুত্বের প্রধানতম দিক, যার পরিমান হাজার কোটি টাকা। এক সময় হালদা ছিল ইরাবতি ডলফিন আর নানা জাতের মাছসহ প্রায় ১৬৬ প্রজাতির জলজ প্রাণীর এক চমৎকার আবাসস্থল। আজ তা কেবল কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। জেনে বা না জেনে আমরা তার অনেক ক্ষতি সাধন করেছি। এখন বোধহয় প্রতীক্ষায় আছি স্বর্ণগর্ভা হালদার শেষ কান্না এবং করুণ পরিনতি দেখার জন্য।
হালদা পৃথিবীর একমাত্র মিঠা পানির জোয়ার-ভাটার নদী। হালদার সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য নদী যেমন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদির সংযোগ না থাকার ফলে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের জীনগত মজুদ সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে। তাই এই নদীকে বাংলাদেশের রুই জাতীয় মাছের প্রধান বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিন ব্যাংক বলা হয়। প্রতি বছর হালদা নদীতে একটি বিশেষ সময় ও পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস মাছ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়টিকে ‘তিথি’ বলা হয়ে থাকে। মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু অমাবশ্যা বা পূর্ণিমার তিথির অনুকুল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার ওই বিশেষ সময়কে স্থানীয়ভাবে আবার ‘জো’ বলা হয়। জো এর বৈশিষ্ট্য হল আমাবস্যা বা পূর্ণিমা হতে হবে। সেই সাথে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত। এই বৃষ্টিপাত আবার স্থানীয়ভাবে হলে হবে না উজানেও হতে হবে। ফলে নদীতে পাহাড়ী ঢলের সৃষ্টি হয়। তাতে করে পানি খুব ঘোলা ও খরস্রোতা হয়ে ফেনা আকারে প্রবাহিত হয়। এরপর জোয়ার-ভাটার প্রতীক্ষা। পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণ ভাটার শেষে পানি যখন স্থির হয়ে যায় তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে। অবশ্য ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলক অল্প ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার অনুকুল পরিবেশ না পেলে মা মাছ ডিম না ছেড়ে নিজ দেহের মধ্যেই নষ্ট করে ফেলে। ডিমগুলো এতই ক্ষুদ্র যে, খালি চোখে দেখা কষ্টকর। সংগ্রহ করা ডিম স্থানীয় পদ্ধতিতে নদীর পাড়ে খননকৃত গর্তে রাখা হয়। তিন থেকে চার দিনে ডিম থেকে রেণু পোনা মাছ বের হয়। তারপর হাত বদল হয়ে চলে যায় মৎস্য ব্যবসায়ীদের কাছে। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মৎস্য চাষীদের কাছে। ডিম থেকে পোনায় রূপান্তরিত হওয়ার সময় স্বচ্ছ পানিতে পোনাগুলোকে সোনালি রঙের দেখায় এবং এই কাজে মৎস্যজীবীদের যে পরিমাণ লাভ হয় তা স্বর্ণ কেনাবেচার থেকেও অধিক। তাই হালদাকে স্বর্ণগর্ভাও বলা হয়ে থাকে।
হালদা নদীতে পতিত দুপারের পানির প্রবাহগুলো প্রশস্ততার বিচারে সাধারণত নদীর পর্যায়ে পড়ে না। বেশিরভাগ ছড়া, খাল, ঝোড়া কিংবা ঝর্ণা জাতীয়। পূর্বদিক হতে যেসব খাল হালদার সাথে মিলিত হয়েছে তার উৎপত্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে। পশ্চিম দিক থেকে মিলিত হওয়া খালগুলোর উৎপত্তি সীতাকুন্ডের পাহাড়সমূহ। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে হালদা নদী প্রবাহিত হয়েছে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে। হালদায় মিলিত হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে উৎপন্ন খাল বা উৎসগুলো হল, মানিকছড়ি, ধুরুং, তেলপারই, সর্তা, কাগতিয়া এবং ডোমখালী। সীতাকুন্ড পাহাড়মালা থেকে বেয়ে আসা খালগুলো হল, গজারিয়া, ফটিকছড়ি,হারুয়ালছড়ি, বারমাসিয়া, মন্দাকিনী, বোয়ালিয়া এবং কপালী।
বর্তমানে এ নদী যথাযথ পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, পরিবেশ দূষণ, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মা মাছ শিকার, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ এবং সময় সময় নদীর বাঁক কেটে সোজা করা সহ মানবসৃষ্ট নানাবিধ কারণে বিপদ সম্পন্ন। তাই প্রতি বছর মা মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। পরিণতিতে বঞ্চিত হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারী ও জেলেরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে এবং যুগ যুগ ধরে তাদের পূর্বসুরীদের ঐতিহ্যবাহী পেশা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। একই সাথে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা। এখান থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে, যা এই মহানগরীর সুপেয় পানির প্রধান উৎস। হালদার পানিতে হেভী মেটাল নামক উপাদানের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান থেকে কম। সুতরাং বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির উৎস হিসেবে এ নদীর পানি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মাছের ডিম ছাড়ার কারণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে থাকে তা হল, একটি বিশেষ সময় বা তিথিতে নদীর ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ডিম ছাড়ার অনুকুলে থাকা। অর্থাৎ নদীতে পতিত ঝর্ণা বা ছড়ার মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ উজান থেকে বয়ে আসা ঢল, নদীর বাঁক ও গভীরতা পরিমিত তাপমাত্রা, তীব্র স্রোত, ফেনিল ঘোলাত্ব, জোয়ার-ভাটার ক্রিয়া ও বজ্রসহ প্রচুর বৃষ্টিপাত একটি বিশেষ সময়ে বা তিথিতে উপযুক্ত মাত্রায় বিরাজ করা। রাসায়নিক প্রভাবকগুলো হচ্ছে কম কন্ডাক্টিভিটি বা তাপ ও তড়িৎ সঞ্চালন শক্তি এবং সহনশীল দ্রবীভূত অক্সিজেন। আর জৈব প্রভাবকগুলো হল, উজানের বিল ও পাহাড়ি ছড়া বা ঝর্ণা বিধৌত পানিতে প্রচুর ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান থাকায় নদীর পানিতে মাছের খাদ্যের প্রাচুর্যতা থাকা যা প্রজনন পূর্ব গোনাড বা ডিম্বাশয় পরিপক্কতায় সাহায্য করে।
মৎস্য খাতে জাতীয় পর্যায়ে প্রতি বছর হালদা নদীর অর্থনৈতিক অবদান ৮০০ কোটি টাকা। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ছয় শতাংশের উৎস হালদা নদী। এক গবেষণায় দেখা গেছে একটি মা মাছ প্রতি বছর চার ধাপে মৎস্য উৎপাদন করে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। আর এক গবেষণার তথ্য অনুসারে একটি মা কাতলা মাছ হালদায় পাঁচ বছরে ডিম ছেড়েছে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। এখানকার মাছের বৃদ্ধির হার অন্যান্য উৎসের মাছের তুলনায় অনেক বেশি তাই দেশের মৎস্য চাষী বা খামারীরা হালদার মাছ চাষ করে অধিক লাভবান হতে পারে। সরকারি তথ্য মোতাবেক ১৯৪৬ সালে হালদায় ডিম উৎপাদন হয়েছিল চার হাজার কেজি। সে সময় সারা দেশের দুই তৃতীয়াংশ পুকুরের মৎস্য চাষ হালদার পোনা দিয়েই করা হতো। এমনকি ভারত ও বার্মা (মায়ানমার) হালদার পোনা নিয়ে যেত চাষের জন্য।
বিশ্বজুড়ে বিপন্ন প্রায় ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) ডলফিনের এই প্রজাতিকে অতি বিপন্ন বা লাল তালিকাভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের কোথাও ২০০টির বেশি এই প্রজাতির ডলফিন দেখা যায় না। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তার অন্যতম প্রধান কারণ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নদীগুলোতে নোনা ও মিঠাপানির অনুকূল ভারসাম্য।
বিশ্বজুড়ে বিপন্ন প্রায় ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) ডলফিনের এই প্রজাতিকে অতি বিপন্ন বা লাল তালিকাভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের কোথাও ২০০টির বেশি এই প্রজাতির ডলফিন দেখা যায় না। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তার অন্যতম প্রধান কারণ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নদীগুলোতে নোনা ও মিঠাপানির অনুকূল ভারসাম্য। সারা বিশ্বে বর্তমানে ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা মোটে সাত হাজার। বন বিভাগের উদ্যোগ ও জাতীসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এর অর্থায়নে এক বছর ধরে চলা এক জরিপে দেখা গেছে সাত হাজারের মধ্যে বাংলাদেশেই আছে প্রায় ছয় হাজার। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বন্য প্রাণী বিষয়ক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডাব্লিউসিএস) এর পক্ষ থেকে ২০০৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের ডলফিনের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ করা হয়। এরপর একই সংস্থা থেকে আলাদাভাবে ইরাবতী ডলফিনের ওপর আর একটি জরিপ করে এবং তা একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ পায়। তাতে প্রথম বেরিয়ে আসে বাংলাদেশে ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ, ৫ হাজার ৮০০টি। যেখানে কোন দেশে ২০০টির অধিক ইরাবতী ডলফিন দেখা যায় না সেখানে হালদা নদীতেই আছে ১৫০টির বেশি। স্থানীয়ভাবে এগুলো শুশুক বা উতোম নামে পরিচিত। এরা গেঞ্জেস বা গাঙ্গেয় ডলফিন নামেও পরিচিত।
উদ্বেগের বিষয় হল মানুষের নানাবিধ কর্মকান্ডের ফলে বছরের পর বছর ধরে হালদা নদীর জীববৈচিত্র ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। হালদায় প্রায়ই ভেসে উঠছে মৃত ডলফিন ও মা মাছ। ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ রাউজানের মাদুনাঘাট এলাকা থেকে একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। এর আগে একই মাসের ১০ তারিখে নদীর খলিফাঘোনা এলাকা থেকে ৮ কেজী ওজনের একটি মা মৃগেল মাছ ভেসে উঠে। মার্চের ৪ তারিখ হাটহাজারীর গরদোয়ারা আমতুয়া এলাকায় মরে ভেসে উঠে ১২ কেজি ওজনের মা কাতলা ও ৩ কেজি ওজনের মা আইড় মাছ। প্রতিটির শরীরে ক্ষতের চিহ্ন ছিল। হালদা রক্ষা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মঞ্জুরুল কিবরিয়ার মতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা যায় সবগুলোর মৃত্যু হয়েছে বালুবাহী ড্রেজার বা নৌযানের পাখার আঘাতে। অপর একটি সূত্র মতে ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ সালের ২০ জানুয়ারী, এই সাড়ে চার মাসের মধ্যে ১৬টি ডলফিন মারা যায়। কারণ হিসেবে নৌযান ও ড্রেজারের আঘাতের কথা উঠে আসে। আর একটি সূত্র মতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত হালদায় ২২টি ডলফিন মারা গেছে। কারণ হিসেবে এখানেও ওই একই বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া গেছে। রাউজান উপজেলার সাত্তারখালের মুখ থেকে হাটহাজারীর মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় দশ কিলোমিটার এলাকা ডলফিনের মূল বিচরণ ক্ষেত্র। বিশেষ করে এই এলাকার মধ্যেই মৃত ডলফিনগুলো পাওয়া যাচ্ছে। অধিকন্তু, মাঝে মধ্যেই নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি মাছ মরে ভেসে থাকা একটি সহজ ব্যাপারে রূপ নিয়েছে।
প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী। নদীর উজানে ফটিকছড়ি ভোজপুর এলাকায় দুটি রাবার ড্যামের কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে হালদার একটি অংশ। নদী থেকে নির্বিচারে বালু তোলায় এর মাটির গঠন নষ্ট হচ্ছে। তীরে একের পর এক গড়ে ওঠা ইট ভাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে নদীর মাটি ও পানি। গত একশ বছরের বিভিন্ন সময়ে নদীর ১১টি স্থানের বাঁক কেটে নদীকে সোজা করে ফেলা হয়েছে। এতে করে মাছের বিচরণ ও প্রজনন কমে এসেছে। কারণ উল্লেখিত মাছেরা ডিম ছাড়ার জন্য উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বেছে নেয় এই বাঁকগুলো। হালদার জীববৈচিত্র ও মাছের প্রজনন নিয়ে কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। এই গবেষণায় হালদার জন্য ক্ষতিকর অন্তত ১০টি কারণ চিহ্নিত করা আছে, যার সবকটি মানবসৃষ্ট। যেমন, নদী থেকে প্রতিদিন চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উত্তোলন, মা মাছ নিধন, খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে নদীর তীরে তামাক চাষ, যন্ত্রচালিত নৌযান থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে নদীর পানি দূষিত হয়ে যাওয়া এবং ফটিকছড়ির চা-বাগানগুলোর জন্য নদীর পানি ব্যবহার। এছাড়া আবাসিক, শিল্প ও ট্যানারির বর্জ্য ভয়াবহ প্রভাবে দূষিত হয়ে চলেছে হালদা নদী। উল্লেখ্য, ফটিকছড়িতে ১৭টি এবং ভোজপুরে ১৩টি চা বাগান রয়েছে। বাগানগুলোর পানির মূল উৎস হালদা। এই গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন গবেষক। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সম্পূর্ণ কাজে দিকনির্দেশনা প্রদান ও সহযোগীতা করেছেন পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। ‘ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অন আপস্ট্রিম ওয়াটার উইথড্রয়াল টু কনসার্ভ ন্যাচারাল ব্রিডিং হ্যাবিটেট অব মেজর কার্পস ইন দ্য রিভার হালদা’ (উজানের পানি প্রত্যাহারে হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণের প্রভাব মূল্যায়ণ) শিরোনামের গবেষণা কার্যক্রমটি ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কার্য্যালয়ের হিসেবে দেখা যায়, ২০১২ সালে হালদা নদী থেকে উৎপাদিত মাছের রেণুর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৬৯ কেজি, ২০১৩ সালে তা অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে। অর্থাৎ ৬১২ কেজি, ২০১৪ সালে ৫০৮ কেজি, ২০১৫ সালে ১০৬ কেজি এবং ২০১৬ সালে ১৬৭ কেজি রেণু সংগ্রহ করা হয়। অবশ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে গবেষকরা একমত হতে পারেননি। তাদের হিসাবে গত পাঁচ বছরে সংগৃহীত রেণুর পরিমাণ আরও অনেক কম। তারা বলছেন, ২০১২ সালে হালদা থেকে সংগৃহীত রেণুর পরিমাণ ছিল ৩৫৪ কেজি, ২০১৩ সালে ৭০ কেজি, ২০১৪ সালে ২৭৫ কেজি, ২০১৫ সালে ৪৭ কেজি এবং ২০১৬ সালে মাত্র ১২ কেজি। গবেষক দলের প্রধান বুয়েটের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক উম্মে কুলসুম নভেরা প্রচার মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, মূলত ২০১২ সালে হালদা নদীতে বাঁধ দেওয়ার পর থেকেই মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ কমে গেছে। গবেষক দল ডিম সংগ্রহের সময় জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছেন। মৎস্য কার্য্যালয় কিভাবে এত রেণূ সংগ্রহের হিসাব বের করেছে তা কারও জানা নেই।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কার্য্যালয়ের মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপ-পরিচালকের ভাস্য মতে কৃষি বিভাগ ও এলজিইডি বাঁধ দেওয়ার সময় মৎস্য বিভাগের সাথে কোন পরামর্শ করেনি। নদী পাড়ের শিল্প-কারখানাগুলোর বেশি ভাগেরই ইটিপি বা তরল বর্জ্য শোধনাগার নেই। যে কয়েকটির আছে তা সব সময় চালু করা হয় না অথবা অচল। ফলে ট্যানারি ও কারখানার দূষিত বর্জ্য সরাসরি গিয়ে নদীতে পড়ে। হাটহাজারীর খন্দকিয়া, কাটাখালী, বাথুয়া, কৃষ্ণখালী, শাহ মাদারী ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বামনশাহী খাল বেয়ে বিভিন্ন শিল্পকারখানার ও গৃহস্থালির বর্জ্য পড়ে হালদা নদীতে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চলমান আবাসিক এলাকার মাস্টার ড্রেনটি বামনশাহী খালের সঙ্গে যুক্ত করা। এর ফলে বামনশাহী ও হাটহাজারীর কুয়াইশ খালের মাধ্যমে নগর ও হাটহাজারীর বিশাল এলাকার বর্জ্য হালদায় গিয়ে মিশছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের এক প্রতিবেদনেও এসব তথ্যের উল্লেখ আছে।
বুয়েটের গবেষক দল হালদার দূষনের মাত্র পরিমাপের জন্য ২০১৫ সালে শিল্প-কারখানা রয়েছে এমন ১৩টি স্থানের পানির মান তিন দফা পরীক্ষা করে। প্রতিটি স্থানেই পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) ও বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) সর্বনিম্ন পর্যায়ে পাওয়া গেছে। প্রতি লিটারে কোথাও ডিও পাওয়া গেছে দশমিক ১৭ মিলিগ্রাম, কোথাও ১ দশমিক ৪ তো কোথাও দশমিক ১১। অন্যদিকে বিওডি পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ৪ মিলিগ্রাম। যেখানে ডিও ৪ দশমিক ৫ এর নিচে নামলে তাতে জলজ প্রাণী বাঁচে না এবং বিওডি ৬ এর কম থাকা জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। গবেষণায় যুক্ত মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, মৃগেল ও কাতলা মাছের খাদ্য প্ল্যাঙ্কটন আর রুই ও কালিবাউশের খাদ্য বেনথোস। বাঁধের কারণে নদীর নিচের অংশে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই দুই খাদ্যের উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
তামাকের বিষে উৎসমুখেই দূষিত হচ্ছে হালদা। খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়, মানিকছড়িসহ পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে নদীটির দুই তীরে প্রায় আট বছর ধরে তামাকের চাষ চলমান। তামাকের নির্যাস ও চাষে ব্যবহৃত সার এবং রাসায়নিক মিশ্রিত পানি সরাসরি পড়ছে নদীতে। হালদার উৎপত্তিস্থলের নিচে মানিকছড়ি এলাকায় শত শত একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। তামাকক্ষেতে সেচ দেওয়ার জন্য পাশের হালদা নদীতে বসানো হয় মেশিন। ক্ষেতের পাশেই তৈরি হয় মাটির চুল্লি, যে চুল্লিতে তামাক পাতা শুকিয়ে পোড়ানো হয়। তামাক কোম্পানিগুলো চাষীদেরকে শুকনো মৌসুম (নভেম্বর-মার্চ) শুরুর সময় অগ্রিম অর্থ সহায়তা দেয়। এরপরের ধাপে দেয় তামাক বীজ, সার ও কীটনাশক। নদীতে ডিম ছাড়ার সময় এপ্রিল থেকে জুন মাস। অথচ এর আগেই শুকনো মৌসুমে উজানে তামাক চাষ হয়। তামাক চাষের উচ্ছিষ্ট পচা পাতা, কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ধোয়া পানি বৃষ্টির সাথে নদীতে পড়ে। এছাড়া চুল্লিতে তামাক পাতা পোড়ানোর কারণে পাতার উচ্ছিষ্ট অংশও কোন না কোনভাবে নদীতেই পড়ে। ফলে নদীর জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে। বিশেষ করে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মাছের প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ। হালদা নদীতে মাছের প্রজনন ফিরিয়ে আনতে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হালদা নদীর প্রাকৃতিক সৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ নামের এক প্রয়কল্প বাস্তবায়ণ করে জেলা মৎস্য কার্যালয়। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল। প্রকল্প চলাকালে ২০০৭ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দুই দফায় ২০ কিলোমিটার করে সাত্তারঘাট থেকে মদুনাগাট এবং নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট মোট ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। যেখানে মাছ, ডলফিন ও অন্যান্য প্রাণী নিরাপদে বিচরণ করার কথা ঠিক সেখানেই প্রচন্ড শব্দ তুলে দিনরাত চলছে যন্ত্র চালিত নৌযান, নির্বিচারে উত্তোলন করা হচ্ছে লাখ লাখ ঘন মিটার বালু।
আর দেরি না করে হালদাকে পরিবেশগতভাবে বিপদ সম্পন্ন এলাকা বা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করে এটা রক্ষণাবেক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে হালদা নদী থেকে সমস্ত মাছ শুধু নয় অন্যান্য প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ফিচার ছবি : আন্তজাল থেকে সংগ্রহীত।
সাম্প্রতিক সময়ের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংকটকে সবার সামনে তুলে আনার জন্য লেখক অবশ্যই প্রসংশার দাবীদার। লেখাটি পড়ে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে তা হলো- ইঞ্চিন চালিত নৌকা ও ড্রেজার ব্যবহার, নদীপাড়ে ব্যাপকহারে তামাক চাষ, বাঁধ নির্মাণ এবং কৃত্রিম উপায়ে নদীর বাঁক সোজার করার মত হটকারী কুকর্মের বিরুদ্ধে প্রশাসন দ্রুত কঠোরভাবে বন্ধ না করতে পারলে সত্যি আমরা হারিয়ে ফেলেবো আমাদের স্বর্ণগর্ভা সমৃদ্ধ হালদা নদীকে…..
যথাযথ মন্তব্য। নদী বা প্রাকৃতিক অন্যান্য সম্পদ রক্ষায় আমাদের দেশে যে আইন আছে আপাদত তার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারলেই যথেষ্ট। তথাপি সময়ের সাথে আইনের সংস্কার বা পরিবর্রনও জরুরি।