সুন্দরবন হল বাংলাদেশের ফুসফুস সমতুল্য। অনন্তকাল ধরে সকল প্রকার দূষণকে নির্বিঘ্নে হজম করে আমাদের কল্যাণে সরবরাহ করে চলছে অক্সিজেন ও প্রাণদায়ী নির্মল বায়ু। বিভিন্ন সময় সমুদ্রে লঘুচাপের ফলে উৎপন্ন প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড়ের সামনে জননীর মত বুক পেতে দিয়েছে আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য। অবলীলাক্রমে সহ্য করেছে বহু আঘাত। যার ফলে বারবার তাকে অবর্ণনীয় ক্ষতির স্বীকার হতে হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র সময় তা আমরা লক্ষ্য করেছি। সুন্দরবন না থাকলে এই ঘুর্ণিঝড়গুলোর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কোন পর্যায়ে দাঁড়াতে পারতো তা ভাবনার অতীত। অথচ আজ যেন আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই সুন্দরবনের হত্যা লীলায় সামিল হয়েছি। উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য। সেই দিক বিবেচনায় রেখে বাগেরহাট রামপালে অর্থাৎ সুন্দরবনের সন্নিকটে ২৬৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। উৎপাদনের জন্য আমরা বেছে নিয়েছি কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ পদ্ধতি। কোন এক সময় ব্যপক গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত বা উদ্ভাবিত নানা প্রযুক্তির মধ্যে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রযুক্তিকে পরিবেশের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়। তাহলে এত কিছু জানার পরও কেন আমরা সুন্দবরবনের ক্ষতি সাধন করে বিদ্যুৎ খাতের উন্নতি ঘটাচ্ছি? প্রযুক্তি আর প্রকৃতি না সমার্থক হয়ে উঠার কথা? যে মানুষটি বৃক্ষের পাতা ভালোবাসে, পাখির কলোরবে বিমোহিত হয়, ঝিঝি পোকার ডাকে উদাস হয়ে যায় অথবা নদীর স্রোতের সাথে মনে মনে সাঁতার কেটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল এমন একজন মানুষও কি পাওয়া যাবে যিনি এই প্রকল্পকে মন থেকে সমর্থন করছেন?
প্রযুক্তি আর প্রকৃতি না সমার্থক হয়ে উঠার কথা? যে মানুষটি বৃক্ষের পাতা ভালোবাসে, পাখির কলোরবে বিমোহিত হয়, ঝিঝি পোকার ডাকে উদাস হয়ে যায় অথবা নদীর স্রোতের সাথে মনে মনে সাঁতার কেটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল এমন একজন মানুষও কি পাওয়া যাবে যিনি এই প্রকল্পকে মন থেকে সমর্থন করছেন?
বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় দুইশত বছর পূর্বে সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট নানাবিধ কারণে বর্তমানে তার আয়তন এসে ঠেকেছে মাত্র ১০,৭৫৭ বর্গ কিলোমিটারে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভক্তির পর বনের ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) অংশে এবং বাকি ৪০ শতাংশ বা ৪৭৪০ বর্গ কিলোমিটার ভারতে পড়েছে। আমাদের দেশের দক্ষিণ অংশে পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের ব-দ্বীপ এলাকায় অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনভূমির। পরষ্পর সংযুক্ত প্রায় চারশত নদী-নালা ও খাল এবং প্রায় দুইশত ছোট বড় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত স্বীকৃত বা আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ প্রজাতি উদ্ভিদের সংখ্যা মোট ৫০টি, যার মধ্যে আমাদের সুন্দরবনেই রয়েছে ৩৫টি। বিপন্ন প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবীর একমাত্র এখানেই বাস করে। এছাড়াও প্রায় ২২ ফুট দীর্ঘ লোনা পানির কুমির, দুইটি বিশেষ প্রজাতির ডলফিনসহ নানান দুর্লভ প্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল সুন্দরবন। সুন্দরবন না থাকলে এসব প্রাণী হয়তো পৃথিবীর বুক থেকে কবেই চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। অধিকন্তু এই বনভূমিতে রয়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, অতিথি ও স্থানীয় মিলে পাখি রয়েছে প্রায় ৩২০ প্রজাতির, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং প্রায় চারশত প্রজাতির মাছ। দেশের অধিকাংশ মধু ও মোম সংগ্রহ হয়ে থাকে এখান থেকে। সরকারি হিসেব মতে বছরে গড়ে ১ লাখ ৫০ হাজার কেজী মধু সংগ্রহের উৎস সুন্দরবন। সরকারের অনুমোদন নিয়ে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিভিন্ন ধরনের বনজ সম্পদ অহরণ করে থাকে, যা তাদের জীবন নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। একই সাথে এখান থেকে প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যুক্ত হয় মোটা অঙ্কের রাজস্ব। দেখা যায় এই পাঁচ লক্ষ মানুষ এবং তাদের পরিবারের আরও কয়েক লক্ষ মানুষ কোন না কোনভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভশীল।
আমরা উপকুলীয় অঞ্চল জুড়ে বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। প্রসঙ্গক্রমে উক্ত পরিকল্পনার কথা আলোকপাত না করলেই নয়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জাইকার আর্থিক সহায়তায় ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১০’ (পিএসএমপি-২০১০) প্রণয়ন করে। পিএসএমপি-২০১০ থেকে জানা যায়, ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৮% জিডিপি বৃদ্ধির মডেল ভিত্তিক এই মহাপরিকল্পনায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। জাইকার তত্তাবধায়নে BIG-B (the Bay of Bengal Industrial Growth Belt) এর অনুকুলে বাংলাদেশ পাওয়ার সিষ্টেম মাস্টার প্ল্যান এর কাজ চলমান। বিগ-বি পরিকল্পনার আওতায় মাতারবাড়ি-মহেশখালি কেন্দ্রিক কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুতের এক বিশাল হাব বা চক্রকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। এটা পায়রা সমুদ্র বন্দর এমনকি মংলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। এছাড়াও মহেশখালি-মাতারবাড়ি বেল্টে তাপবিদ্যুৎ হাবের সাথে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) পোর্ট স্থাপনের বিষয়টি তো আছেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন পরিণতিতে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকুলীয় অঞ্চলের পরিবেশ। হুমকির মুখে পতিত হতে পারে এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি। ঘটবে বিপর্যয়, যার ভয়াবহ প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে না জীববৈচিত্রের আধার খ্যাত পৃথিবীর অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন ‘সুন্দরবন’।
পিএসএমপি-২০১০ অনুযায়ী ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কয়লা ভিত্তিক ১৯ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৮০০ মেগাওয়াট আমদানিকৃত কয়লা থেকে। এই পরিকল্পনার অনুকুলে ইতিমধ্যেই ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৫টা এবং ৭০০ মেগাওয়াট ১টা সহ মোট ৭৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। সে লক্ষ্যে সরকার থেকে সরকার (Government to Government) ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তিও প্রায় সম্পন্ন। উল্লেখ্য, এর বাইরেও কিছু আমদানি নির্ভর কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ অনেকাংশে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগের বিষয় হল পরিবেশ দূষণকারী-কয়লা।
আমরা জানি রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প একটি কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প। প্রকল্পের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, কয়লা আমদানি করা হবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কয়লা রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ইন্দোনেশিয়ার সরকার ক্রমেই কয়লা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার দরুণ ধারণা করা হয়েছিল কেবল অস্ট্রেলিয়া থেকেই আমদানি করা হবে। দেখা গেল তারাও কয়লা রপ্তানি করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে আগেই। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে আমরা সহজ সমাধানটি বোধহয় খুঁজে পেতে যাচ্ছি ভারতের নিকট। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ তো এমন ধারণাই পোষণ করছেন। তাছাড়া সম্প্রতি ভারতের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, মানগত দিক বিবেচনায় ভারতে উৎপাদিত কয়লা উন্নত নয়। অথচ বিদ্যুৎ বিভাগ কয়লা আমদানি বিষয়ক প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মোজাম্বিক থেকে কয়লা আমদানির সুপারিশ করেছিল যেখানে ভারতের নাম ছিল না।
কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে আমাদেরকে রক্ষাকারী অসাধারণ জীববৈচিত্র সম্পন্ন সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী সুন্দরবন এ দেশের জীবনের অন্যতম উৎস। পলি ধরে রাখে এবং জোয়ার ঠেকিয়ে উর্বর পলি জমিকে রক্ষা করে। ঘুর্ণিঝড় ঠেকিয়ে আমাদের জীবন বাঁচায়। আমাদেরই জীবন ধারণের জন্য উজার করে দেয় তার বনজ ও জলজ সমস্ত সম্পদ। পরিবেশ সমীক্ষা (ইআইএ) অনুযায়ী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা আমদানি করা হবে। সাধারণত প্রতি ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০ টন কয়লা পোড়াতে হয়। সে হিসেবে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনে দৈনিক ১৩ হাজার ২০০ টন কয়লার প্রয়োজন পড়বে। প্রশ্ন হল, এই ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে বছরে যে বিশাল পরিমাণ (৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ) ছাই উৎপন্ন হবে তার ব্যবস্থাপনা আমরা কিভাবে করব? এই উভয় ধরণের ছাই ও তরল ঘনীভূত ছাই ব্যাপক মাত্রায় ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিবেশ দূষণ করে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধাতু যেমন- আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, ক্যাডমিয়া, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম সহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য উপাদান মিশে থাকে। এই বর্জ্য ছাইয়ের বিষাক্ত ভারি ধাতু নিশ্চিত ভাবেই বৃষ্টির পানির সাথে মিশে, চুইয়ে ভূমির উপরিভাগ ও নীচের পানির স্তর দূষিত করে ফেলবে, যার প্রভাব হবে দীর্ঘ মেয়াদী ও ভয়াবহ।
উৎপাদিত ছাই সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এই তথ্যের উপর দেশবাসী কোন ক্রমেই আস্থা রাখাতে পারছে না। কারণ তারা জানে সিমেন্ট কারখানাগুলো ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার করতে মোটেও আগ্রহী নয় বরং তারা বিজ্ঞাপনে তাদের সিমেন্ট ফ্লাই অ্যাশ মুক্ত এই বিষয়টি গুরুত্বের সহিত প্রচার করে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বড়পুকুরিয়ায় মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন দৈনিক ৩০০ মেট্রিক টন ছাইয়েরই কোন উপযুক্ত ব্যবহার আমরা আজও করে উঠতে পারিনি। এসব ছাই ফেলা হচ্ছে প্রকল্প এলাকার অ্যাশ পন্ড বা ছাইয়ের পুকুরে যার ফলে ঘটছে পরিবেশ বিপর্যয়। আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষি জমি ইতোমধ্যেই হারিয়েছে ফসল উৎপাদনের সক্ষমতা। পানি ও বাতাসে দেখা দিচ্ছে বিষাক্ত উপাদান। অধিকন্তু প্রকল্প এলাকার আশপাশে বিগত সময়ের তুলনায় বর্তমানে বৃষ্টিপাত আশংকাজনক হারে কমে গেছে। ভরা বর্ষা মৌসুমেও আশানুরূপ বৃষ্টি হয় না। তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে রামপালের মত বৃহৎ প্রকল্পে কি ঘটবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এখানে ছাইয়ের পুকুরের জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা পশুর নদীর একেবারেই তীরে নির্মাণ করা হবে। ফলে দূষিত ধাতব পদার্থ ও দূষিত পানি ছড়িয়ে পড়বে সুন্দরবন তথা আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। ক্যান্সার বাসা বাধবে বাংলাদেশের ফুসফুসে। ছাইয়ের পুকুর থেকে এ ধরণের দূষণ ঘটার বহু উদাহরণ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে মাত্র কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া দু’একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে কিংস্টোন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাইয়ের পুকুর থেকে ১১০ কোটি গ্যালন ফ্লাই অ্যাশ স্লারি Aomori ও Clinch নদীতে বাহিত হয়ে মারাত্মক দূষণ ঘটায়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডিউক এনার্জির ছাইয়ের পুকুর থেকে ৫০ হাজার থেকে ৮২ হাজার টন ছাই ও ২ কোটি ৭০ লক্ষ গ্যালন ছাই দূষিত পানি ড্যান নদীতে বাহিত হয়ে এক ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটায়। তার রেশ এখনও ঐ অঞ্চলে পিছু ছাড়েনি।
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং তার ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে কথা বলতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া আরও একটি ঘটনার উল্লেখ না করলে নয়। সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে যেমন ১৪ কিলোমিটার দূরত্বের কথা যেনে আমরা আশ্বস্ত হচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ফায়েত্তি কাউন্টিতে ১৯৭৯-৮০ খ্রিষ্টাব্দে ১২৩০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সময়ও একইভাবে স্থানীয়দেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছিলো। এমনকি কিছু দিন পর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ১২৩০ থেকে ১৬৯০ মেগাওয়াটে উত্তীর্ণ করা হয়। এর ফলাফল তৎক্ষণাৎ বোঝা না গেলেও বোঝা গেল কিছু দিন পর। যখন ৭০ থেকে ১৩০ ফুট উঁচু বিশালাকৃতি পেকান বৃক্ষগুলো একে একে মরতে শুরু করলো। ১৯৮০ থেকে ২০১০ খ্রিষ্টব্দের হিসেবে ফায়েত্তি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিঃসরিত বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস বিশেষ করে সালফার ডাই অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় পেকান, ওক, এলম সহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আক্রান্ত হয়, বহু পেকান বাগান ধ্বংস হয়ে যায়, ১৫ থেকে ২০ হাজার বিশালাকৃতির পেকান বৃক্ষ মারা যায়। অধিকন্তু এই ক্ষতিকর প্রভাব পৌঁছে যায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারদিকের ৪৮ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত। ফায়েত্তি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিষাক্ত গ্যাস বা সালফার ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ছিল বছরে গড়ে ৩০ হাজার টন। সালফার ডাই অক্সাইড নিঃসরণের ফলে সালফার ও এসিড দূষণে ৪৮ কিলোমিটার জুড়ে গাছপালার এই অবস্থা যদি হতে পারে তাহলে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব কি হতে পারে তা রীতিমত ভাবনার বিষয়। সরকারি হিসেবে এখান থেকে দৈনিক ১৪২ টন হারে বছরে প্রায় ৫২ হাজার টন সালফার ডাইঅক্সাইডের নিঃসরণ ঘটবে। সুতরাং বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সুন্দরবনের পরিণতি কী হতে পারে তা কি আমরা আন্দাজ করতে পারছি? এছাড়াও লাখ লাখ মেট্রিক টন কয়লা আনা-নেয়া করা হবে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী দিয়ে। শব্দ ও পানি দূষণ হয়ে দাঁড়াবে এখানকার সার্বক্ষণিক ঘটনা। সুন্দবনের প্রায় ছয় শতাধিক প্রজাতির গাছপালা, বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ শত শত প্রজাতির পশুপাখি ও সরীসৃপ ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। অবধারিতভাবে ভেঙ্গে পড়েবে সুন্দরবনের জীবন চক্র।
পরিবেশ বিপর্যয় জনিত ক্ষয়ক্ষতি ও প্রযুক্তিগত দিক বিবেচনা করে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশই শুধু নয় খোদ চীনও তাদের বেশ কিছু কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল ঘোষণা করে এই প্রযুক্তি থেকে সরে আসর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ২০১০ সালে প্রণীত পরিবেশ বিষয়ক নির্দেশিকাতে উল্লেখ করেছ যে, বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ এ ধরণের বিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ ঘটে, যা প্রকল্প এলাকার বনাঞ্চল তথা জীববৈচিত্রকে ভয়ানক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। অথচ আমাদের দেশে সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাগেরহাটের রামপালে তৈরি হচ্ছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এর উৎপাদন ক্ষমতা ১৩২০ করে দুই দফায় ২৬৪০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। আর এই বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ ও পরিচালনার যৌথ অংশীদার সেই ভারতের কোম্পানি এনটিপিসি। প্রকল্পের প্রাথমিক দফা বাস্তবায়নে ব্যয় হবার কথা ১৪,৫৮৩ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন: নবায়ন, কো-জেনারেশন, নাবায়নযোগ্য জ্বালানী, লোড ব্যবস্থাপনা এবং সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাত্র ছয় থেকে বার মাসের মধ্যে ন্যুনাধিক পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৪,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, যা দেশের বর্তমান ঘাটতি মিটিয়ে উদ্বৃত্ত হিসেবে থেকে যেতে পারে।
ওদিকে রামপাল প্রকল্প ঘিরে দেশের শিল্প উদ্যোক্তাগণ দেখতে শুরু করেছেন এক নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রকল্প এলাকার আশপাশে যে যেখানে পারছে হামলে পড়ছে। পত্র-পত্রিকার খবরাদি এমনকি সম্প্রতি ইউনেস্কো কর্তৃক পেশকৃত প্রতিবেদন থেকেও জানা যায় রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে যাচ্ছে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান, যার জন্য উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যেই জমি ক্রয়ের বিষয়টি অনেকাংশে এগিয়ে নিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে উন্নয়ন হিসেবে প্রতীয়মান হলেও ব্যপারটা আসলে কতটুকু পরিবেশ ও বিজ্ঞান সম্মত? ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের এই বিশ্ব বাস্তবতায় এর চেয়ে অধিকতর উপযুক্ত প্রশ্ন কি হতে পারে তা জানা নেই। কারণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন কেবল একটি বনই নয় একমাত্রও বটে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শত বিকল্প আছে কিন্তু একটি সুন্দরবনের বিকল্প আর একটিও হতে পারে না। ইউনেস্কো (UNESCO) প্রতিবেদনেও কথাটির স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ নীতি-নির্ধারকদের পানে এখনও আশায় বুক বেঁধে তাকিয়ে আছে- প্রকৃতি আর প্রযুক্তি যে সমার্থক এই বোধোদয়ের ভিত্তিতে অচিরেই সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি তথা দেশের পরিবেশ রক্ষায় যুগোপযোগী ও বাস্তব সম্মত কোন সিদ্ধান্ত আসবে।
তথ্যসূত্র:
- http://whc.unesco.org/en/soc/2868)
- https://policy.asiapacificenergy.org/sites/default/files/PSMP2010_reduced.pdf
- http://envfor.nic.in/sites/default/files/TGM_Thermal%20Power%20Plants_010910_NK.pdf
- http://www.northcarolinahealthnews.org/dan-river-coal-ash-spill-timeline
- https://www.scienceleadership.org/media/open/6998
- http://envfor.nic.in/sites/default
- http://www.huffingtonpost.com/2010/12/28/farmers-pecan-growers-say_n_801945.html
- http://www.bbc.com/news/uk-england-oxfordshire-21881129
9. http://developmentdebacles.blogspot.com/2008/02/grievous-mae-moh-coal-power-plant.html
10.http://www.taipeitimes.com/News/taiwan/archives/2016/03/07/2003641014
11. রামপাল ইআইএ