দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান প্রাণীকূল আজ অসহায়। কি পরিমাণ অসহায় তা যেমন পরিমাপ করা সাধ্যের অতীত তেমনি ভেবেও কূল-কিনারা করা সম্ভব নয়। প্রবল এক ঝাকুনিতেই থেমে গেছে পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রের চাকা, থেমে গেছে মানুষের কোলাহল ও নিত্য কর্মকান্ড। জল, স্থল, আকাশ অস্বাভাবিক রকমে যানবাহনের দৌরাত্ম্য মুক্ত, বিদ্যালয়ে অনেক দিন কোন ঘন্টা বাজে না, শিক্ষার্থীদের কলোরবে গম গম করে না কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সকাল সকাল কারখানা অভিমুখে শ্রমিকদের ছুটতে দেখা যায় না। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখতে হয় না কোন নরপতির কুৎসিত মুখাবয়ব অথবা শুনতে হয় না সে মুখে উচ্চারিত হুঙ্কার বা মিথ্যা ভালোবাসা ও মিথ্যা মানবতার বাণী। সভ্য পৃথিবী অতীতে আর কখনও এমন করে অচল হয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায় না। মাত্র কয়েকটা দিনেই বদলে গেছে আমাদের প্রাণ প্রিয় ধরিত্রী। সাড়ে তিন মাস আগের পৃথিবী আর আজকের পৃথিবীর মাঝে কি বিস্তর ফারাক তা ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়।
হাজার বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই মানব সভ্যতা আজ এক ভয়ঙ্কর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকার ধরণটাই বদলে যাচ্ছে। সামাজিক চিত্রটা হয়ে যাচ্ছে ওলোটপালোট। এটা অলৌকিক, আকশ্মিক বা দুর্ঘটনা কোনটাই নয়। সভ্যতার লাগামহীন দৌরাত্মের কি এমনই পরিণতি হওয়ার ছিল না? এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এখনও কি বিশ্বাস করতে হবে মানুষ এই পরিণতির কথা টেরই পায়নি? যদি তাই না হয় তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানি কিভাবে দাবী করছেন যে ২০১৫-১৬ সাল থেকে উন্নত দেশগুলোকে সতর্ক করা হচ্ছিল, যে কোনো সময় আঘাত হানতে পারে কোন ভয়ঙ্কর মহামারি, পাল্টে দিতে পারে গোটা পৃথিবীর চালচিত্র, মানব সভ্যতাকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের সামনে। উল্লিখিত প্রশ্ন দুটি যেমন আমরা উপলব্ধি করেছি তেমনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানির সতর্ক বাণীও শুনেছি কিন্তু সত্যটা হল, এত কিছুর পরও পৃথিবী জুড়ে চলমান অস্থির ও অসুস্থ্য অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার মানসিকতা আমাদেরকে থামতে দেয়নি। পরিণতিতে সভ্যতার তথাকথিত চাকাকে সচল রাখতে অবলীলাক্রমে ধ্বংস করে চলেছি পরিবেশ, যখন খায়েশ হয়েছে তখনই ধরিত্রীর টুটি টিপে ধরেছি, প্রকৃতি আর প্রযুক্তিকে সমার্থক করে তোলার বিষয়টি আলবৎ উপেক্ষা করেছি।
আজকের এই নির্মম বিশ্ববাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ভবিষ্যদ্বাণী বা আশঙ্কার কথা যদি উড়িয়েও দেয়া হয় এটা সত্যি এবং বাস্তব যে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনের ফলে দ্রুত কমছে দূষণের মাত্রা। মধ্য মার্চেই পৃথিবীর আকাশ থেকে অবিশ্বাস্য গতিতে কমেছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপাদানগুলো। শুধু চীন, ইতালি এবং ব্রিটেনের আকাশেই নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা অনেক কমে গেছে। নিউইয়র্কের আকাশে দূষণের মাত্রা কমছে ৫০ শতাংশের বেশি। ঘরবন্দী মানুষ খালি চোখেও দেখতে পাচ্ছে ঝকঝকে নির্মল আকাশ, স্মরণকালের মধ্যে যা আর কখনও দেখা যায়নি। বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ঘোলা জলরাশি ফিরে পেয়েছে তার নীল রং। সেখানে ফিরে এসেছে সৈকতেরই হারিয়ে যাওয়া সন্তান ডলফিনের দল, আনন্দে মুক্ত মনে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে দিনভর। পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়ার পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে দেখা যাচ্ছে প্রায় দেড়শত কিলোমিটিার দূরের হিমালয় পর্বতমালার বরফ ঢাকা শৃঙ্গ। পৃথিবীর ব্যস্ততম শহর মুম্বাই-এ ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ ও অন্যান্য প্রাণী। সভ্যতার তাপে ও চাপে দূরে সরে যাওয়া নিরীহ কচ্ছপের ঝাঁক উড়িশ্যার সমুদ্র সৈকতে এসে নির্ভয়ে আরাম করছে, ডিম ছাড়ছে। ভেনিসের ব্যস্ততম নদীগুলোর পানিতে এসেছে ঝকঝকে যৌবন, রংবেরং এর মৎস্যকূল সানন্দে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। জাপানের শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ায় থমকে যাওয়া শহরের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে কত কত প্রাণী। দল বেঁধে ফিরে আসছে পরিযায়ী পাখির দল। গোটা মানবসভ্যতাকে সত্যিই কেউ যেন প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। মানুষ ঢুকে পড়েছে ঘরের কোণে, সমস্ত যন্ত্রের চাকা কে যেন পিছন থেকে টেনে ধরেছে। ফলে শুধু চীনেই ফেব্রুয়ারি-মার্চে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি।
২০১৮ সালের অক্টোরে ৯০টি দেশের জলবায়ু বিজ্ঞানীগণ এক যৌথ বিবৃতিতে আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, সুন্দর একটি পৃথিবীর জন্য বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হলে; ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বর্তমানের চেয়ে কমপক্ষে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। হ্যা, এমনই এক প্রত্যাশাকে সামনে রেখে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সনদ ও কিয়োটো সনদের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে সম্পাদিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘প্যারিস চুক্তি’। কত স্বপ্নই না লুকিয়ে ছিল এই চুক্তির ভিতরে! স্বল্প সময়ের জন্য হলেও পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কথা ভুলে গিয়ে, সীমান্ত ও বিভাজন রেখার কথা ভুলে গিয়ে গোটা পৃথিবী সেদিন দাঁড়িয়েছিল এক আকাশের নিচে, নিজেদেরই সৃষ্ট শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ায়ের জন্য, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য নিরাপদ একটি পৃথিবী রেখে যাওয়ার জন্য। প্যারিস চুক্তিতে সই করেছিল ১৯৫টি দেশ। পৃথিবীতে এর আগে সুনির্দিষ্ট কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে এর অধিক সংখ্যক রাষ্ট্রের সম্মিলন ঘটেনি। এটা প্রমাণ করে কম-বেশি সদিচ্ছা প্রত্যেকেরই ছিল। আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বলতেই হয় অভাব ছিল সেই সদিচ্ছাকে অর্থবহ ও কার্যকর করে তোলার।
প্যারিস চুক্তিতে বলা আছে, চলতি শতাব্দীর মধ্যে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হবে। উল্লেখ্য, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কখনই এ চুক্তিতে সম্মত হতে চায়নি। পরবর্তীতে তারা অবশ্য নিজ নিজ অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে সম্মত হয়, যা এক ধরনের সফলতা বলেই বিবেচিত হবার কথা। উল্লেখ্য, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশের শীতল মাথা রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প চার বছর পর ২০১৯ সালে স্বার্থপরের মত এই চুক্তি থেকে তার দেশকে বের করে নিয়ে গেলেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তির বাইরে থাকা একমাত্র দেশ। সত্যিকার অর্থে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিশ্বের দেশগুলোকে প্রথমবারের মত ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল প্যারিস সম্মেলনের বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি। তখন গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে আনতে ২০০টির মত দেশ যে ঐকমত্য পোষণ করেছে তাকে অনেক পর্যবেক্ষকই ঐতিহাসিক অর্জন বলে অভিহিত করেন। চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি বা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখা এবং জলবায়ু তহবিল গঠন ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল গাছ, মাটি ও সমুদ্র প্রাকৃতিকভাবে যতটা গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণ করতে পারে; ২০৫০ সাল থেকে ২১০০ সালের মধ্যে কৃত্রিমভাবে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ সেই পর্যায়ে নামিয়ে আনা, যা আগামী দিনের পৃথিবী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। যদিও অনেকে এই সনদকে তাসের ঘরের সাথে তুলনা করেছেন। কারণ সনদে গ্রিনহাউস নিঃসরণের কথা বলা আছে কিন্তু তা বাস্তবায়নের কোন নিশ্চয়তা নেই। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও রয়েছে জটিলতা। সর্বোপরি প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রাগুলো শুধু চুক্তির কাগজেই থেকে গেছে, বাস্তবায়ন হয়নি। জানি না এখনও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি কি না; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতদিন শুধু আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলতে খুব বেশি সময় লাগল না।
পৃথিবী নামক গ্রহের সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে আমরা কি খোঁজ রেখেছি পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কি পরিমান কার্বন ছড়িয়ে আছে? বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমান প্রায় ৩৫ গিগাটন। শিল্প বিপ্লবোত্তর পৃথিবীতে ইতোমধ্যে গড় তাপমাত্রা বেড়েছ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৬৯ গিগাটন, যার জন্য প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আমরাই দায়ী। অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রাকৃতিক কারণও আছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, কন্টিনেন্টাল ড্রিফট বা মহাদেশিয় সরণ, আগ্নেয়গিরির উদগিরণ, সমুদ্রস্রোত এবং আর্থ টিল্ট বা পৃথিবীর হেলানো অবস্থান। যাই হোক, পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, কার্বন ডাই অক্সাইডের মূল উৎস হল জীবাশ্ম জ্বালানি। মোটাদাগে বলতে গেলে কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও ডিজেলের ব্যবহার। এছাড়াও রয়েছে বন নিধন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক শিল্পায়ন ইত্যাদি। জলবায়ুর পরিবর্তন হওয়ায় বিশ্বের প্রতিটি দেশেই লক্ষণীয়ভাবে কমে যাচ্ছে শীতকালের স্থায়িত্ব। বাড়ছে ভূমি ও পাহাড় ধসের ঘটনা। সংঘটিত হচ্ছে ঘন ঘন দাবানল, যার দগদগে সাক্ষী অতি সাম্প্রতি দা গ্রেট আমাজান ও অস্ট্রেলিয়ার দাবানল। দীর্ঘায়িত হচ্ছে খরা বা অনাবৃষ্টি। ঝড়ঝঞ্ঝা, বন্যা, টর্নেডো, হারিকেন ও সাইক্লোনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন ঘটছে। সেটা কি আমরা লক্ষ্য করার এতটুকু ফুসরত পেয়েছি? খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ছে। বিশেষ করে ১৯৭০ সাল থেকে সমুদ্রের তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কোন কোন সূত্রে জানা যায়, বায়ুমন্ডলে যে কার্বন নিঃসরণ হয় তার এক তৃতীয়াংশ শুষে নেয় সমুদ্রের জলরাশি, এই সুবিশাল পরিমান কার্বন নির্দিধায় হজম করে সদা স্বচেষ্ট থাকে আমাদের জন্য বাসযোগ্য সুন্দর একটা পৃথিবীর নিশ্চয়তা বিধানে। ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এন্টার্কটিকার বরফ যে হারে গলেছে তা আগের দশকের তুলনায় তিন গুন বেশি। হিমালয় পর্বতমালা, মধ্য ইউরোপ এবং আন্দিজ পর্বতমালায় যে হিমবাহ রয়েছে ২১০০ সাল নাগাদ তার ৮০ শতাংশ গলে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে শুধু মাত্র গ্রিনল্যান্ডের সব বরফ যদি গলে যায় তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬ মিটার বেড়ে যাবে। অথচ সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলেই চলতি শতাব্দীর শেষে মালদ্বীপ, পাপুয়া নিউগিনি, বার্বাডোজ, কিরিবাতিসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। ডুবে যাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী নিচু এলাকা।
কার্বন নিঃসরণের পরিমান কমিয়ে আনা মানুষের নাগালের বাইরে নয়। তার মানে আবার এই নয় যে, রাতারাতি তার বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব। কার্বন নিঃসরণ কমানোর সাথে সরাসরি সংযুক্ত শিল্পায়নের বিষয়টি। এক্ষেত্রে হয় শিল্পায়নের হার কমাতে হবে নতুবা শিল্পে জ্বালানির চাহিদা মিটাতে নবায়নযোগ্য বিকল্প প্রযুক্তিগুলো বেছে নিতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় ও ক্ষমতাধর বহুজাতিক কোম্পানি জড়িত আছে। এসব কোম্পানি এতটাই হিম্মতের অধিকারী আর তাদের হাত এতটাই লম্বা যে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতেও এক অদৃশ্য প্রভাব বলয় তৈরি করে রাখে এবং প্রয়োজন মাফিক তা ঠিকঠাক কাজে লাগায়। তারা বোঝে কেবল মুনাফা। ফলে এরা কখনোই নিজেদের বারোটা বাজিয়ে পরিবেশ রক্ষার মত মহৎ কাজ করতে আগ্রহী থাকার কথা নয়। ইকোনমিস্ট বলছে পশ্চিমা দেশগুলো শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে কার্বন ছড়িয়েই আজ ধনী হয়েছে। সুতরাং কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে তাদের অধিক দায়বদ্ধ থাকা উচিৎ। গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে অধ্যাপক সাইমন লুইস বলেছিলেন, বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা প্রয়োজন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর বিষয়টি ক্ষমতা, অর্থ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনকে রাজনৈকিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা অতি জরুরি। আর তখনই কেবল বিষয়টিকে এই সমস্ত কাগুজে চুক্তি থেকে বাস্তবায়নের পথে নেয়া সম্ভব।
বিজ্ঞানের কল্যাণে প্রায় সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে কিন্তু এক অজানা অণুজীবের কাছে আজ আমরা কুপোকাত। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আজ কার্যত গৃহবন্দী। অতি যত্নে গড়ে তোলা বড় বড় শহর-বন্দর যেখানে মাত্র কয়েকদিন আগেও সুখ আর স্বপ্নের বিকিকিনি হতো, দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায় মত্ত মানুষের কোলাহলে গমগম করতো, অথচ আজ তার অলিগলি ভরে উঠছে অচ্ছ্যুত মৃতদেহে। ক্রমবিকশিত এই সভ্যতার সুদীর্ঘ পথ ধরে গড়ে ওঠা সমস্ত সম্পর্ক কয়েক দিনেই ধুলায় মিশে গেছে। বিবাদমান দেশগুলোর মাঝে অস্ত্রের প্রদর্শনি আর ঝনঝনানির উদ্দাম নৃত্য মুহূর্তেই থেমে গেছে। সোজা কথায় সৌরজগতের বসবাসযোগ্য একমাত্র গ্রহ পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত।
দুই-আড়াই দশক পিছনে ফিরে তাকালে উপলব্ধি করা য়ায় বিজ্ঞানের উৎকর্ষ আমাদেরকে কোন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। আমাদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না। অথচ আজকের বাস্তবতায় এই ক্ষুদ্র যন্ত্রটি ছাড়া চলা অসম্ভব, যেন তা বিচ্ছিন্ন কিছু নয় শরীরেরই একটা অঙ্গ। অতএব বুঝে নেয়া মোটেও কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয় যে বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ আমরা কোথায় অবস্থান করছি। এই বিজ্ঞানের কল্যাণে প্রায় সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে কিন্তু এক অজানা অণুজীবের কাছে আজ আমরা কুপোকাত। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আজ কার্যত গৃহবন্দী। অতি যত্নে গড়ে তোলা বড় বড় শহর-বন্দর যেখানে মাত্র কয়েকদিন আগেও সুখ আর স্বপ্নের বিকিকিনি হতো, দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায় মত্ত মানুষের কোলাহলে গমগম করতো, অথচ আজ তার অলিগলি ভরে উঠছে অচ্ছ্যুত মৃতদেহে। ক্রমবিকশিত এই সভ্যতার সুদীর্ঘ পথ ধরে গড়ে ওঠা সমস্ত সম্পর্ক কয়েক দিনেই ধুলায় মিশে গেছে। বিবাদমান দেশগুলোর মাঝে অস্ত্রের প্রদর্শনি আর ঝনঝনানির উদ্দাম নৃত্য মুহূর্তেই থেমে গেছে। সোজা কথায় সৌরজগতের বসবাসযোগ্য একমাত্র গ্রহ পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত।
আমাদের উন্নয়নের মূলমন্ত্র আকাশচুম্বি দালানকোঠা, তথাকথিত উন্নত পথঘাট ও আলো ঝলমলে রঙিন শহর। মানুষের বদ্ধমূল ধারণা এসব ছাড়া কোন কিছুকে উন্নয়ন বলে মেনে নেয়া যায় না। আমদের কি হিসেব আছে এইসব উন্নয়ন করতে গিয়ে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই আমরা প্রকৃতির কি পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছি? ধ্বংস করেছি ৭০ লাখ হেক্টর বনভূমি, পৃথিবীর বুকে নিক্ষেপ করেছি ৫২ কোটি টন সাধারণ বর্জ্য, ১০ কোটি টন বিপজ্জনক বর্জ্য, সোয়া এক কোটি টন ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য, প্রতি সেকেন্ডে আমরা ১ লাখ ৫০ হাজার পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছি। আর সাগর-মহাসাগরগুলো তো ভরে তুলেছি প্লাস্টিক বোতল এবং প্লাস্টিক জাতীয় বিভিন্ন দ্রব্যে। গত ৫ দশকে পৃথিবীর বন্য প্রাণীর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছি। উদ্ভিদ এবং প্রাণী মিলিয়ে প্রতি পাঁচ মিনিটে পৃথিবীর বুক থেকে একটি করে প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মেরুদন্ডী প্রাণীর মোট ওজনের মধ্যে মানুষের ছিল ১ শতাংশ, বাকি ৯৯ শতাংশ ছিল বন্য প্রাণীর। ২০১১ সালে এসে মানুষ দখল করেছে ৩২ শতাংশ এবং মাত্র ১ শতাংশ বন্য প্রাণী। বাকি ৬৭ শতাংশ বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণী। আমদের নিয়ন্ত্রণহীন চাহিদা মেটাতে শকুনের মত উপকারী একটি প্রাণীকে পর্যন্ত প্রতিপক্ষের কাতারে দাঁড় করিয়েছি। গবাদি পশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত অতি উচ্চ মাত্রার রাসায়নিক দ্রব্য সমৃদ্ধ ঔষধের কারণে আমাদের উপমহাদেশ থেকে ৯৯ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত। বাকি ১ শতাংশ আজ কার্যত সংরক্ষণ শিবিরে আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির অপেক্ষায় দিন গুনছে।
আমাদের জীবন দানকারী অসহায় ধরিত্রী হয়তো এই দূষণের ভার আর নিতে পারছিল না, তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চালু হয়ে গেছে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থার সমস্ত কার্যক্রম।
জলবায়ু পরিবর্তনের মত বিষয়টি ‘করোনা ভাইরাস’ সংক্রমণকে প্রভাবিত করছে কি না, এমন প্রশ্নে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট, হেলথ এবং গ্লোবাল এনভার্নমেন্টের পরিচালক অ্যারন বার্নস্টেইন বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রাণীগুলো তাদের আবাসস্থল বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। নতুন জায়গার নতুন পরিবেশে প্রাণীরা নিজেদের খাপ খাওয়াতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় প্রাণীদের সংস্পর্শে আসছে। ফলশ্রুতিতে ছড়াচ্ছে ভাইরাস, সংক্রমিত হচ্ছে প্রাণী থেকে মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে এটা নাকি সবে শুরু, করোনা ভাইরাসজনিত কারণে সৃষ্ট মহামারিতে গোটা পৃথিবী হয়ে যাবে অন্য কোন পৃথিবী, পাল্টে যাবে আমাদের জীবনযাত্রা, মানসিকতা তথা দৃষ্টিভঙ্গি। পৃথিবীটাকে নিয়ে আমরা বহু ছিনিমিনি খেলেছি। দেয়ালে পীঠ ঠেকে গেল মানুষ যেমন রুখে দাঁড়ায় তেমনি প্রকৃতিও যে পারে এই কথাটি আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা আমাদের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা অটো ইমিউনিটির কথা খুব ভালো করেই জানতাম কিন্তু বিলক্ষণ ভেবে দেখিনি যে খোদ পৃথিবীরও একটা স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকতে পারে। কে জানে আমাদের জীবন দানকারী অসহায় ধরিত্রী হয়তো এই দূষণের ভার আর নিতে পারছিল না, তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চালু হয়ে গেছে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থার সমস্ত কার্যক্রম।
ফিচার ছবি ও তথ্যসূত্র : আন্তজাল
প্রচুর ম্যাটেরিয়াল পেয়েছি লিখায়। তথ্যবহু।
সবকিছু এতো ভালোভাবে রিলেটেড যে নতুন করে ভাবার সুযোগ পেলাম।
পাঠক আপনাকে ধন্যবাদ।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তথা এর কুফল নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠা ছিল এবং থাকবে।। তৃতীয় বিশ্বে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের শিল্পনীতি ও অথৈনীতির প্রতিযোগীতার ফলে আজকের এই জলবায়ুরপরিবর্ত।। কিন্তু এটাকে বলা হচ্ছে বৈশ্বিক সমস্যা।। প্যারিশ চুক্তি সহ জাতিসংঘ বিভিন্ন বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এর বাসতবায়নের ব্যাপারে শিল্পোন্নত দেশগুলোর আন্তরিকতার খুবই অভাব পরিলক্ষিত করা গিয়েছে।। যার ফলে বিশ্ব পরিবেশ উৎকন্ঠার মধ্যে পরেছে।।।এর থেকে সবাই যখন পরিত্রাণ পেতে রাস্তা খুঁজছি ঠিক প্রকৃতি নিজেই এগিয়ে এলো এর রাস্তা বের করতে।।। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে আজকে যে অলৌকিক পরিবর্তন পরিবেশের তা কিন্তু মানবসভ্যতার দ্বারা সম্ভব ছিল না, আর থাকলেও তা কতদিনে সমভব ছিল তা বলা কঠি।।। সে হিসেবে আজকের বিশ্ব পরিবেশের এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের এই ভূমিকা কাকে একদিক থেকে আশীর্বাদ হিসেবেই দেখতে হবে।। প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুর হলে প্রকৃতি তা প্রতিদান দেয় তাই প্রমান এই করোনা ভাইরা…..!!!
বিগত প্রায় প্রতিটি শতাব্দীতেই বিভিন্ন মহামারীর স্বীকার হয়েছে এই সভ্য পৃথিবী কিন্তু আমাদের শিক্ষা হয়নি। বিশেষ করে গত শতাব্দীতে পৃথিবী মুখোমুখী হয়েছে অনেক বড় বড় মহামারীর, তবুও আমাদের শিক্ষা হয়নি। প্রকৃতি বারবার আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা তার কোনই তোয়াক্কা করিনি। পরিণতিতে আজ আমরা ভয়াবহ রকমে আসহায়। আমাদের হুশ হতে আরও কতদিন লাগবে?
এক কথায় অসাধারণ। অনেক কিছু জানতে
পারলাম।
এক কথায় অসাধারণ। অনেক কিছু জানতে পারলাম।
পাঠক আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।