তানক্ষানাই তং অভিযানের আদ্যপান্ত
প্রারম্ভিক:
২০১৬ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে তানক্ষানাই তং (Tankhanai Taung) এর সাথে পরিচয় হয়। পূর্বে সাকা হাফং ও মোদক মোয়াল (জ্যোতলাং) থেকে দক্ষিণ দিকে বেশ কিছু উঁচু পাহাড় দৃষ্টি কাড়ে। উঁচু পাহাড়গুলোর শেষ মাথায় ঙাসাই হুঙ এই বিষয়টি জানাই ছিল। তবে নাসাই (ঙাসাই হুঙ) থেকে উত্তর দিকেও বেশ কিছু উঁচু পাহাড় মানচিত্রে পাওয়া যায়। সেই থেকেই এর প্রতি ক্ষীণ একটা আগ্রহ জাগে। ক্রমশঃ ঙাসাই হুঙ-কে কেন্দ্র করে চিন্তা ও আগ্রহের দানাগুলো একত্রিত হতে থাকে। তারপর ছুটে চলা…নানা কারণে অভিযানগুলো লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। তবে যেটা হলো, তানক্ষানাই তং হঠাৎ করেই পাদপ্রদীপ আলোয় চলে আসলো। ২০১৭ সালে আমি ও বুনো পুরনো মানচিত্রের উপর নির্ভর করে পর্বতটিতে একটি অভিযানের প্রস্তুতি নেই। Save The Hills & Nature এর ব্যানারে আরও কিছু লক্ষ্য যুক্ত হওয়ায় অভিযানটির নাম দেই “Mru a Glimpse Study”.
বন্ধুবর বুনোর ভাষ্যে সেই অভিযানের কথা:
“কোন এক ঘোর বর্ষায় ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে স্বপ্নবাজ তিন যুবক মিলে বেড়িয়ে পড়েছিলাম পাহাড়টির খোঁজে। কিন্তু সময়টা ছিলো অনেক বেশি বৈরি। প্রতিদিন ভারী বৃষ্টিপাত আর হড়কাবান পথের দুর্গমতাকে যেন শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্ত এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতিও অভিযানে কিছুটা প্রভাব ফেলেছিলো। তবুও সেই অভিযানে সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে লক্ষ্যের অনেকটা কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছিলো। মনে পড়ে অন্য একটি রিজের উপর থেকে শেষ বিকেলে চুরি যাওয়া আলোয় মুগ্ধ নয়নে দেখেছিলাম কি এক ভাব-গাম্ভীর্য আর দাম্ভিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তানখানাই তং, কিছুক্ষণ পরে মেঘ সরে গিয়ে দেখা দিয়েছিলো দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সীমানা প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় নাসাই হুঙ। এগুলো সব প্রথম অভিযানের স্মৃতিকথা।”
তানক্ষানাই তং কে কেন্দ্র করে এটিই ছিলো প্রথম অভিযান। প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতায় অভিযানটি সফল হয়নি তবে আমরা দমে যাইনি। আমাদের আগ্রহ বেড়ে গেল দ্বিগুণ। এবার অতীতের প্রতিকূলতাগুলোর যেনো পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আরও নিখুঁত প্ল্যান করা হয়। যা বাস্তবায়নে নিতে হয়েছে কিছু দুর্দান্ত সাহসী পদক্ষেপ। যুক্ত হলো স্বপ্নবাজ আরও তিন যুবক (খোকা বাবু, তাহমিদ আল মাসুম, পেয়ার আলম)। আটঘাঁট বেঁধেই নেমে পরলাম পরিকল্পনা করতে। রাতের পর রাত পাঁচ যুবকের ঘুম হারাম করে তৈরি করা হলো আমাদের অভিযান পরিকল্পনা। তবে এর সাথে যুক্ত হয়ে গেল আরও কিছু দুর্দান্ত লক্ষ্য। অভিযানটির নাম দেয়া হল-“Walking Throug The Reserve”. তবে শতভাগ সাফল্য এবারও ধরা দিল না। সময়ও বৈরি হয়ে উঠল। অধরা কাজটি সম্পন্ন করতে আরও একটি অভিযানের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। আর সেই অভিযানটিই হলো- ‘Expedition Southern Leopard’ বাংলায় আমরা বলি ‘শঙ্খের চিতা’।

অভিযানগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
Mru a Glimpse Study: এই অভিযানটি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। সময় হিসেবে আমরা বেছে নিয়ে ছিলাম বর্ষাকালকে। অভিযানটির দুইটি প্রধান লক্ষ্য ছিলো। প্রথম লক্ষ্য তানক্ষানাই তং দ্বিতীয়টি সাঙ্গু-মাতামুহুরী বন ও বনে বসবাসকারী ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা। আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম তানক্ষানাই তং এর উত্তর ঝিরি ‘ওয়ানওই’ ধরে আরোহণ করবো। এই অভিযানটির সদস্য ছিলেন তিন জন-
১) মির্জা রাসেল।
২) বুনো।
৩) ফেরদৌস রলিন।
অভিযানটি প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতার জন্য শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তবে এই অভিযান থেকে অনেক তথ্য ও নতুন একটি ঝর্ণার সন্ধান করতে গিয়ে দুর্ধর্ষ এক গল্পের জন্ম দেয়। সে গল্প অন্য দিন হবে।

Walking Throug The Reserve: এই অভিযানটি অনেকগুলো মানুষের স্বপ্নকে একটি লক্ষ্যে নিয়ে আসার গল্প। শীতকালীন এই অভিযানটির লক্ষ্য ছিল বেশ বিস্তৃত। অনেক স্টাডি করে প্রায় নিখুঁত পরিকল্পনা করা হয়। অভিযানটি সফল করার জন্য ব্যক্তিগত কিছু রেকি অভিযানও করা হয়। যা পরবর্তীতে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনেক সাহায্য করেছিলো। যার মধ্যে ছিল আমার একক দুটি অভিযান, তাহমিদ ও পেয়ার আলমের কিছু দলগত অভিযান।
‘Walking Throug The Reserve’ অভিযানটির সদস্য ছিলেন প্রথম দিকে পাঁচ জন-
১) মির্জা রাসেল।
২) এবোরিজিন্যাল বুনো।
৩) খোকা বাবু।
৪) তাহমিদ আল মাসুম।
৫) পেয়ার আলম।
সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর বুনো পারিবারিক কারণে অভিযানটিতে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।। তবে আমাদের বিভিন্নভাবে লজিস্টিকস সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। ২০২০ এর জানুয়ারির শেষ দিকে আমাদের অভিযানটি শুরু হয়। অভিযানটির ভিতরে আরও খন্ড খন্ড কিছু অভিযান ছিল। প্রথমবারের মতো ‘ঙা হুঙ’ আরোহণ করে অভিযাত্রী দলটি। ‘ঙা হুঙ’ মিথ ভেঙে এর বন্য সৌন্দর্যের মুগ্ধতা জাগানিয়া দৃশ্যপট সকলকে মোহগ্রস্ত করে তোলে। চিম্বুক রিজ প্রথাগত পথে অতিক্রম না করে ঙা হুঙের ভয়ঙ্কর সুন্দর বনের ধাঁধাঁ আতিক্রম করে শংখের জলে ক্লান্ত পা ভিজিয়ে প্রত্যাশিত পাড়ায় (পাড়াটির নাম প্রকাশ করা হলো না সঙ্গত কারণেই) পৌঁছাতে সক্ষম হই। সব ঠিকঠাকই চলছিল তবে সীমান্তের খুব কাছেই কিছু অনভিপ্রেত স্থাপনা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য এবারও খুব কাছ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। আশাহত হয়েছিল দলের সকলেই। এই ভাবে উটকো একটা কারণে অভিযানটির মূল লক্ষ্য হাত ছাড়া হবে তা কেউ প্রত্যাশা করেননি।

তৃতীয় পক্ষ ও STHN এর যৌথ সফল অভিযান: এই অভিযানটিতে STHN এর পেয়ার আলম অংশগ্রহণ করেন। মূলত আমাদের পূর্ববর্তী অভিযানটির পথ ধরে বেশ সময় নিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়। সাফল্যও আসে তবে এবারও শতভাগ নয়। এই অভিযানের অন্যতম দিক হচ্ছে তানক্ষানাই তং স্পর্শ করা। এই অভিযানের অভিযাত্রীগণ হচ্ছেন-
১) পেয়ার আলম।
২) তাওহীদ যশী।
৩) জহিরুল ইসলাম।
৪) রুমানা ইসলাম।
দলটি ২৮শে ডিসেম্বর ২০২১, দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ তানক্ষানাই তং এর উত্তর চূড়া আরোহণ করতে সক্ষম হয়। উত্তর চূড়ার উচ্চতা পাওয়া যায় ২৬৫০ ফুট।
Expedition Southern Leopard (শংখের চিতা): এই অভিযানটি ছিল তরুণ ও প্রবীণের মেল বন্ধনের অভিযান। ব্যক্তিগত নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অভিযানটি বার বার পিছিয়ে যাচ্ছিল। কোনভাবেই অভিযানের সদস্যরা একটি অভিন্ন সময় নির্বাচিত করতে পারছিলেন না। অবশেষে অন্যদের সম্মতিতে মাত্র দুই জন এই অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। অভিযানটি খুব দ্রুততার সাথে এবং স্থানীয় কারও সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ন আল্পাইন স্টাইলে করবো এই ছিল আমাদের পরিকল্পনা। এই অভিযানের অভিযাত্রীগণ হচ্ছে-
১) মির্জা রাসেল।
২) পেয়ার আলম।
পরিকল্পনা মাফিক নির্ধারিত সময়েই আমরা যাত্রা শুরু করি। এই অভিযানটির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সময় স্বল্পতা ও ঋতু। অভিযানটির ব্যপ্তী ছিল মাত্র ১১ দিন। বসন্তের সৌন্দর্যের আড়ালে যে ভয়ঙ্কর একটি রূপ থাকে তা আমরা ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছি। মুরি অ’র (মাতামুহুরী) জলে পা ভিজিয়ে আমাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। বসন্তের প্রকৃতি আমাদের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা মাত্র ৪ দিনে আমাদের বেইজ ক্যাম্প পাড়ায় (পাড়াটির নাম উল্লেখ করা হলো না) পৌঁছে যাই। দূরত্বটা নেহায়েত কম নয়, স্থানীয়দেরই ৫/৬ দিন লেগে যায় এই পথ অতিক্রম করতে।
বসন্তে সবুজ পাহাড় আর সবুজ থাকে না। মিশ্র পাতা ঝড়া বনের ‘সবুজাভ-লোহিত’ বিচিত্র রঙ আর পথে থাকে নানা ফুল ও ঝড়া পল্লবের গালিচা। প্রখর রৌদ্র তাপ মাথায় নিয়ে ছায়াহীন-মায়াহীন পুরনো জুমের পথ চরম পরীক্ষা নিবে। তারপর যখন গর্জন, চাপালিশ, বৈলামের বিশাল বন পাহাড়ের শিরদাঁড়ায় এখনও অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আপনাকে স্বাগতম জানাবে। কি বিচিত্র সেই দৃশ্য! বনের বুকেই আঘাতের চিহ্ন; কুঠার আর আগুনের ক্ষত বুকেই নিয়ে বলছে ‘এবার থামো, আর পারি না। আমি কি কেবল আঘাতই পাবো?’

ফাওয়াইন সো এর শীতল জলে পা ভিজিয়ে ১০ মার্চ পূর্ব দিকে অগ্রসর হয় দু-জনের দলটি। এই মায়ার বন এবার নিরাশ করেনি। চাওয়ার চাইতেও বেশি দিয়েছে। ভোরেই আমরা ঝিরি ধরে যাত্রা শুরু করি। এই পথে সীমান্ত অবধি মানুষের চিহ্ন পাওয়া যাবে না। আজ হাঁটা পথ কম তাই কিছুটা আয়েসি ভাবেই দিনের শুরু করি। অল্প সময়ের মধ্যেই দুই পাহাড়ের মাঝগলে গিরিপথের মতো একটা জায়গায় চলে আসি। আমার একটু সামনে হাঁটছে পেয়ার। হঠাৎ কিছু না বলেই সে থমকে দাঁড়ায়। একেবারে প্রস্তর মূর্তির মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। হঠাৎ করেই উত্তরের খাড়া দেয়ালের গাছ-লতা বেয়ে নেমে আসলো একটি ‘সূর্য ভাল্লুক’। তার বাদামি শুভ্র পাগুলো টিপে টিপে জল পার হচ্ছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে অনভিপ্রেত আগুন্তকদের দেখে সেও বিস্মিত। বার দুই তাকিয়ে চট জলদি ফিরতি পথ নিল। ভাল্লুক গাছে চড়তে পটু তবে আমাদের অবাক করে চোখের পলকেই খাড়া দেয়াল বেয়ে উপরের বাশঁ বনটাতে সে হারিয়ে গেল। মাত্র মিনিট খানেকের দেখা। আমরা দু’জনই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বন্য পরিবেশে মাত্র বিশ হাত সামনে থেকে ভাল্লুক দেখার ঘোর কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় নিল পেয়ার। ভাগ্য ভাল ছিল তাই ভাল্লুকটি মারমুখী হয়নি। দিনের শুরুটা হলো অন্য রকম কিছু দিয়ে। সারা পথ আফসোস কোন ছবি তুলতে না পাড়ার জন্য। ঝিড়ি ও বনের এই অংশটুকু এখনও জীবন্ত। চিতা, লেমুর, বানর, সিবেট ও সাম্বার হরিণের সাথে সাক্ষাতের পূর্ব অভিজ্ঞতা হয়েছে এখানেই। নির্জন ঝিরি পথে বড় বড় বোল্ডারগুলো পাড়ি দিয়ে এসে দাঁড়াই একটি ঝর্ণার সামনে। সূর্য তখনও পশ্চিমে হেলে পড়েনি । পানির উৎস থাকায় আজ রাতে এখানেই তাঁবুবাসের সিদ্ধান্ত নেই। ব্যাকপ্যাক নামিয়ে আমরা ক্যাম্পসাইট তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দু’জনে ট্রেকিংয়ের এই ব্যাপারটা বেশ মজার। চারটি হাত নিরবে সব কাজ করে যাচ্ছে। তাঁবু খাটিয়ে রান্নার আয়োজন শুরু করলাম। আগুনে কিছু কাঠখড়ি গুজে দিয়ে দু’জনে এটা সেটা নিয়ে গল্প করছিলাম। আগুনের শিখার স্ফুলিঙ্গের সাথে গল্পের শাখা-প্রশাখাও বাড়তে থাকে।

প্রকৃতিতে এখন সন্ধ্যার আয়োজনের ঘনঘটা। দিনের আলো থাকতে থাকতেই আহার পর্ব শেষ করে আগুনের পাশেই পাথরে গা এলিয়ে আধ শোয়া হয়ে আমরা দু’জন। এতক্ষণ টুকটাক কাজের জন্য আওয়াজটা কানে আসলেও গা করিনি। পেয়ার বার কয়েক ইশারা করে বলেছে, ভাইয়া রাঙপাঙ মনে হয় (ম্রোদের ভাষায় ধনেশকে রাঙপাঙ বলা হয়)। শুকনো ঝর্ণার গা বেয়ে ক্ষীণ একটা জলধারা অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। ঝর্ণার মাথায় দক্ষিণ দিকে বেশ বড় একটা গাছ। আধ শোয়া অবস্থায় দিব্যি দেখতে পাচ্ছি এক জোড়া কাউ-ধনেশ (Oriental Pied Hornbill) সংসার পেতেছে। কিছুক্ষণ পর ভুল ভাঙল এক জোড়া নয়, তিন জোড়া ধনেশের সংসার এই গাছ ও পাশের একটি গাছে। ধনেশের ডানা ঝাপটানোর শব্দের সাথে সন্ধ্যা নেমে আসে। আগুনের মুখোমুখি বসে আছি আমরা দুই অভিযাত্রী। ধীরে ধীরে জেগে উঠছে রাতের মায়াবি বন। তক্ষক, কাঠ বিড়ালী, রাত জাগা পাখির ডাকে মুখরিত সেই চরাচর। আকাশে শুক্লা নবমীর চাঁদ ক্যানপির (Canopy) ফাঁক গলে করুণা করে কিছু জোছনা বিলিয়ে দিচ্ছে।
আগামীকাল সকালে আমাদের কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। ঘুমানো দরকার তবুও জেগে আছি। ভাল্লুকের কথাটা মাথা থেকে যাচ্ছে না। যদিও আমরা অনেকটা দূরে চলে এসেছি। হয়তো তার টেরিটরির বাহিরে। তবে এই বনে আরও ভাল্লুক আছে, আছে ছোট বাঘ। রাত্রি প্রথম প্রহর শেষ হলে বিকালের বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট খাবার খেয়ে ঘুমাতে চলে যাই। ভোরে উঠেই আমাদের পরিকল্পনা মতো তাঁবু গুটিয়ে নেই এবং বড় রুকস্যাক দুটি পাহাড়ের কিছুটা উপরের একটি গর্তে লুকিয়ে রেখে পা বাড়াই তানক্ষানাই তং এর উদ্দেশ্যে। অবশেষে পথের সকল পাজল ভেঙে এসে দাঁড়াই চূড়ার আগের একটি বনফোরের সামনে। ‘বনফোর’ হচ্ছে ইংরেজি বর্ণ ওয়াই (Y) আকৃতির পথ বিভাজন। যেখানে একটি পথ দু’দিকে ভাগ হয়ে যায় এরকম স্থানকে ম্রোরা বলেন ‘বনফোর’। আমাদের আগের অভিযানে উত্তরের চূড়াটিতে আরোহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এবারের লক্ষ্য দক্ষিণের উচ্চতম চূড়াটি। তানক্ষানাই তংয়ের দুইটি চূড়া। উত্তরের চূড়া হতে দক্ষিণের চূড়াটিতে আরোহণ সম্ভব নয়। ফাল্গুন আর চৈত্রের সন্ধিক্ষণে প্রায় খাড়া বাঁশ বনটা ধরে আমরা আরোহণ শুরু করি। এই অভিযানে তাৎক্ষণিক সব সিদ্ধান্তই আমাদের পক্ষে ছিল। আমাদের ভাবনার সাথে বাস্তবতার ব্যত্যয় হলো না। একটু হেরফের হলেই পথ ভুল হয়ে যেতে পারে। একবার পথ ভুল হলে তা শুধরে নিয়ে পুনরায় চেষ্টা করা প্রায় অসম্ভব। কেননা এই দীর্ঘ পথে পানির কোন উৎস নেই। স্থানীয়দের কেউ এই পথে ভুলেও পা বাড়ায় না। এমনকি তানক্ষানাই তং-এ স্থানীয় অধিবাসীদের কেউ আরোহণ করেননি। বসন্তের এই বৈরি পরিবেশে কেবলি বাঁশ বন ধরে উপরেই উঠছি। গাছ আর বাঁশের ফাঁক দিয়ে যখন পূবের আকাশ দেখা যাচ্ছিল তখন বুঝতে বাকি নেই, আমরা চূড়ার কাছেই আছি। অবশেষে কাক্ষিত চূড়াটির দেখা পাই। বসন্তের মাতাল হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে গেলেও সূর্যের রুদ্র মূর্তির জন্য টেকা দায়। বাংলাদেশের পূর্ব দিকের পাহাড়গুলো থেকে অনেকবার বার্মা (মায়ানমার) দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। কিন্তু এবার দেখে আশাহত হলাম। ওপাশে খুমীদের জুমে ছোট-বড় সব পাহাড় সয়লাব। দূরে দুটি খুমি গ্রাম দেখা যায়। পি-অ বয়ে চলেছে। আমার যাকে পিক্ষ্যাং নামে জানি। চূড়াটির উত্তরে একটি পাথুরে জায়গা আছে। এখান থেকে পশ্চিম দিকে ওয়ালি তং কে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেই পাথুরে জায়গাটি বার্মার অংশে পূর্ব দিকে বের হয়ে আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে ঙাসাই হুঙকে দেখে নিলাম। উত্তরের চূড়া স্পষ্টতই বুঝা যায় বেশ কিছুটা নিচু। অবশেষে তানক্ষানাই তং আমাদের আপন করে নিল। শেষ হলো দীর্ঘ একটা স্বপ্নের। এবার ফেরার পালা। ফিরে আসাটা অতটা সহজ ছিল না। বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। সে গল্প অন্য কোন সময়ের জন্য তুলে রাখলাম…।
অভিযানের নাম করণ: এই অভিযানের মজার একটি দিক হচ্ছে অভিযান শুরু সময় আমরা এর নাম ঠিক করতে পারিনি। এমনকি সামিটেও এ নিয়ে পেয়ার ও আমার মধ্যে কথা হয়। কিন্তু কোন নাম নির্দিষ্ট করতে পারিনি। ফিরতি পথে মাসখানিক আগে একটি চিতা বাঘ শিকারের গল্প শুনি এবং সেই বাঘের মাংস যারা খেয়েছে তাদের কাছে দেখি চিতাটির দাঁত ও জিহ্বার কিছু অংশ। শংখের এই অংশে এখনও চিতাদের দেখা যায়। আমরা এইবার এবং আগেও পাগমার্ক (Pugmark) দেখেছি। চাবাও তুইয়ের জলে (শংখ নদীর ত্রিপুরা নাম) শেষবারের মতো পা ভিজিয়ে ফিরে চলি বাড়ির পথে। চিম্বুকের মায়ার বন যখন পার হচ্ছি তখন মনের অজান্তেই পেয়ারকে বলি এবারের অভিযানের নাম ‘শংখ চিতা’ হলে কেমন হয়। ব্যাস পেয়ার সাথে সাথেই সম্মতি দিয়ে দারুণ একটি ইংরেজি নাম দাঁড় করায়। তাহলে ভাইয়া নামটা ‘Expedition Southern Leopard’ হলে কেমন হয়। একটু বিমূর্ত ধাঁচের এই নামটি সেই চিতাটির জন্যই। যার শেষ পরিণতির একটি চিহ্ন আমার কাছে স্বযতনে রয়ে গেল।
পেয়ার আলমের ভাষ্যে সাঙ্গু-মাতামুহুরী বনের বাঘের কথা শুনা যাক:
“সাঙ্গু মাতামুহুরি রিজার্ভের সবচেয়ে বিরলতম প্রাণী হলো ব্ল্যাক লেপার্ড বা ব্ল্যাক প্যানথার, যেটা ইন্ডিয়ান স্পটেড লেপার্ডের একটি কালার ভ্যারিয়েন্ট। ম্রো–রা একে বলে ‘প্রি মাং মা’। ম্রো শিকারীদের মতে এটি মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে ৮-১২ হাত পর্যন্ত লম্বা হয় (উল্লেখ্য, ম্রোদের পরিমাপ, সময়, দূরত্ব এসব বিষয়ে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে যেমন-এক হাত দৈর্ঘ্যে প্রায় ১.৫ ফিট হলেও ম্রোরা ১ ফিটকে এক হাত হিসেবে গণনা করে)। খুবই ধূর্ত এই প্রাণীকে লোকেট করা দক্ষ শিকারীর পক্ষেও খুব কঠিন। মেলানিস্টিক মেইল লেপার্ড কুচকুচে কালো হয়, ফিমেল লেপার্ডের গায়ে স্পট থাকে। মোটামুটি কমন হচ্ছে ইন্ডিয়ান স্পটেড লেপার্ড ও ক্লাউডেড লেপার্ড। ইন্ডিয়ান লেপার্ডকে ম্রো-রা বলে ‘প্রি চি’, ক্লাউডেড লেপার্ডকে বলে ‘প্লেংকি প্রি’।
সুজন ত্রিপুরা গল্প করছিলেন রিসেন্ট একটা কাহিনী নিয়ে। তখন জুম কাটার সময় চলছে। সুজন দাদা ও তার স্ত্রী কয়েকদিনের জন্য জুম ঘরেই বসবাস করছেন। দিদি পানি আনতে ঝিড়িতে গেছেন, সুজন দাদা জুমঘর থেকে বেরিয়ে দিদির দিকে টর্চের আলো ফেলতেই দেখেন, দিদির কয়েক হাত পিছনেই একটি লেপার্ড। দাদার হাতের কাছে হারপুন সদৃশ একটি অস্ত্র ছিলো, যা দিয়ে মূলত ঝিড়িতে মাছ ধরা হয়। দাদা সেটাই সাথে সাথে ছুড়ে মারলেন। বাঘটি পালিয়ে গেল।
ছবির দাঁতটি একটি ইন্ডিয়ান স্পটেড লেপার্ডের। দৈর্ঘ্যে দুই ইঞ্চির মতো। মাংস হয়েছিলো ১ মণের বেশী। এই দাঁতটি বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়, জিহবা বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকায়। স্থানীয়দের নানা রকম কুসংস্কার আছে। যেমন এক ত্রিপুরা দাদা বিশ্বাস করেন–বাঘের দাঁত গলায় ঝুলিয়ে রাখলে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। আবার ম্রোরা বিশ্বাস করে, এই দাঁত জঙ্গলের খারাপ দেবতাদের দূরে রাখে। হায়রে বিশ্বাস!
যদিও এ রিজিয়নে বিশ্বাসের কারণে এই প্রাণীগুলো হত্যা হয় না। হত্যা হয় ফ্রী খাদ্যের জন্য, শিকারের আদিম প্রবৃত্তিও এর পিছনের অন্যতম একটি কারণ। আমরা যে কি একটা সমৃদ্ধ ও প্রাচীন বন হারাচ্ছি, আমাদের কোন ধারণাই নেই।”

তানক্ষানাই তং পরিচিতি ও অভিযান হতে সংগৃহীত উপাত্ত:
১) বাংলা নাম: তানক্ষানাই তং (ইউ এস ও রাশিয়ান টপো ম্যাপ হতে)
২) ইংরেজি নাম: Tankhanai Taung (ইউ এস ও রাশিয়ান টপো ম্যাপ হতে)
৩) স্থানীয় নাম ও ব্যাখ্যা: তং–খুনাইক-তং [Ton Khonaik Taung (Marma)]। মার্মা ভাষা হতে নামটি এসেছে। স্থানীয়রা এর নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রাপ্ত তথ্য মতে একজন বলেছেন, এই পর্বত সারিটির এই অংশে সাতটি চূড়াকে একত্রে ‘তন-খুনাইক-তং’ বলা হয়। মার্মা ভাষায় খুনাইক মানে সাত (৭)। অপর এক বয়োজ্যেষ্ঠ বলেছেন দু’টি চূড়ার ভিতর একটি চূড়া সাত হাত লম্বা তাই বলা হয় ‘তং-খুনাইক-তং’। আমাদের কাছে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। এই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি প্রায় ৩০ বছর ধরে শংখের উজানে বাস করছেন। পূর্বে তিনি কলাদাইন (কালাডন) নদীর কাছে কোন এক গ্রামে ছিলেন।
৪) অবস্থান: পর্বতটির অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে, মদক রেঞ্জের সাকুদং পর্বতসারিতে। সাকুদং রিজ, মদক রিজ নামেও বহুল প্রচলিত। পর্বতটি সাঙ্গু মাতামুহুরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের আওতাভুক্ত।
৫) প্রাপ্ত টেকনিক্যাল উপাত্ত:
GPS Location: 21°23’33” N 92°38’55″E (Accurate Altimeter)
Received Height:
888m or 2913ft (Altimeter),
2860ft (Wikiloc SRTM)
৬) অন্যান্য তথ্য:
Summit Date: 11.03.2022
Summit Time: 01.05pm
Expedition Name: Expedition Southern Leopard (শঙ্খের চিতা)
Organized By: STHN (Save The Hills & Nature)
৭) উত্তরের চূড়াটির তথ্য (North peak info):
উচ্চতা:2650 ফুট; অবস্থান:21°23.625′ N 92°38.859′ E
ঙাসাইহুংয়ের চূড়ায় দ্বিতীয়বার কোনো অভিযাত্রী দল উঠলে সেটি এই দলটাই হবে..
Amazing!
ধন্যবাদ।