বান্দরবান শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে, একেবারে সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে প্রায় একশত তেইশ কি.মি. দীর্ঘ একটি পাহাড় সারি। যার পুঁথিগত নাম ‘বান্দরবান রিজ’। যদিও এর স্থানীয় নামটি আরো আকর্ষণীয় আরো মায়াবী! ‘চিম্বুক’।বেশীরভাগ মানুষ চিম্বুককে একটি পাহাড় বাঁ একটি রেঞ্জ ভেবে ভুল করে।মূলত এটি একটি পাহাড় সারি। যেমন, তার নামের মায়া, তেমন তার রূপের জাদু।
ভৌগোলিক ভাবে এই পাহাড় সারির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের অন্যতম দুটি পাহাড়ি নদীর প্রধান কিছু উৎস ঝিড়ি ও কন্ট্রিবিউটারি ঝিড়ির জন্ম চিম্বুকের বুক থেকেই। তাঁর পশ্চিম পাশের ঢাল বেয়ে নেমে গেছে মাতামুহুরির প্রধান উৎস মাতা ঝিড়ি বা আন্দালি ঝিড়ি। এছাড়াও দুসরি ঝিড়ি, সিন্ধু ঝিড়ি, পোয়ামুহুরি ঝিড়ি, তৈন খাল সহ আরো অনেক প্রমিন্যান্ট ঝিড়ির জন্ম চিম্বুক থেকেই যেগুলো মাতামুহুরি নদীতে পতিত হয়েছে। অন্যদিকে চিম্বুক পাহাড় সারির পূর্ব দিকে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে চলা নদী শঙ্খেও রয়েছে তার অবদান। লাগপাই ঝিড়ি, ব্র অ শঙ্খের অন্যতম দুটি কন্ট্রিবিউটারি ঝিড়ি। এছাড়া লিকড়ি ঝিড়ি, দাম অ সহ আরো অনেক ঝিড়ি এসে পড়েছে শঙ্খে। তার চলার পথকে করেছে আরো গতিময়।
এই পাহাড় সারিতে রয়েছে দৃষ্টি নন্দন কিছু পাহাড়। যেমন,থাইক্ষিয়াং তং,ওয়াদুই হুং,ক্রিস তং, রুংরাং,লিব্লুং হুং,নন খ,মুরিফা তং, ওয়ারি তং, ঙা হুং,কুলামা হুং ইত্যাদি। এক সময় পুরো চিম্বুক জুড়ে ছিল গহীন অরণ্য। কিন্তু সভ্যতার কড়াল থাবায় এর প্রথমাংশ হারিয়েছে তার জৌলুশ। মানুষের লালসার কাছে হেরে গিয়েছে তার আদিমতা। তার বুক চিরে রাস্তা হয়েছে, সে রাস্তা দিয়ে পাচার হয়েছে হাজার হাজার শতবর্ষী গাছের লাশ।
পাহাড়ে বাস করা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রতিনিয়ত। তাদের খাদ্যের যোগান দিতে বনের বুকে লাগানো হয়েছে আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলেছে তার তরু লতা বৃক্ষ, চিম্বুক সব সয়ে গেছে নীরবে। তাই বলে ভাববেন না চিম্বুকের জৌলুশ শেষ, তার দক্ষিণাংশ এখনও আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। ‘নন খ’ এর একটু আগে থেকে একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি ‘কুলামা হুং’ পর্যন্ত চিম্বুক ধরে রেখেছে তার আদিম সৌন্দর্য। লালন করছে সুপ্রাচীন এক রেইন ফরেস্টকে। যে বনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীদের অভয়ারণ্য, মানচিত্রে যাকে বলা হয় সাঙ্গু-মাতামুহুরি সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
বৃটিশ ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর অভিযাত্রী, চিম্বুকের প্রেমে ছুটে গিয়েছে অনেক মানুষ। লাবণ্যময়ী চিম্বুক বিস্মিত করেছে এমন অনেক মস্তিষ্ককে। আমার ক্ষুদ্র জীবনে কয়েকবার পেয়েছি তার সান্নিধ্য। ভালোবেসে ফেলেছি- এই পাহাড়, এই মায়ার অরণ্য। চিম্বুক পাহাড় সারির একটি পাহাড় অভিযানের অভিজ্ঞতা নিয়েই এই লেখাটি।
এক শীতের সকালে,ঘরের উষ্ণতা আর নিশ্চয়তার মায়াকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ল আমাদের ছয় জনের অভিযাত্রী দল, চার জন বাঙালি ও দুই জন ম্রো। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে চিম্বুকের দক্ষিণ অংশের সীমান্তবর্তী পাহাড় ‘ঙা হুং’ আরোহণ করা। ঙা হুং-এর পূর্বদিকে বাংলাদেশ আর পশ্চিমে মায়ানমার।
ঙা হুং-কে নিয়ে প্রথম স্মৃতি একটু রোমন্থন করি। এক বর্ষায় আনুং পাড়ায় উঠার সময়, বন্ধুবর কং ইয়েঙ দূরের একটি পাহাড় চূড়া দেখিয়ে বললো,দাদা এইটা ওয়ালি তং। কিন্তু দৃষ্টি ওয়ালি তং ছাড়িয়ে আটকে গেল পিছনের উঁচু পাহাড়ে। মেঘে ঢাকা তার চূড়া। সেবারই ঙা হুং-এর সাথে আমার প্রথম দেখা। এরপর ওয়ালি তং এর চূড়ায় দাঁড়িয়ে ঙা হুং-এর দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আবার আসবো আমি:এরপর তোমার জন্য। সবচেয়ে বেশী আকর্ষিত হয়েছিলাম তাঁর বুকে জাপটে থাকা মানুষের স্পর্শবিহীন অরণ্যের প্রতি। তখন অবশ্য ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে এই অভিযান প্রবল ছাপ ফেলবে আমার মস্তিষ্কে।
প্রথমেই বলে নেই- এই লেখাটি যতটা না ‘ঙা হুং’ আরোহণের গল্প, তারচেয়ে বেশী এর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন এক অরণ্যের গল্প; এর অধিবাসীদের গল্প। ওল্ড লেডির অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যতের গল্প।এর মাঝে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যে শারীরিক ও মানসিক জার্নির ভিতর দিয়ে আমাকে ও আমাদের যেতে হয়েছে তাও উঠে আসবে এই লেখায়। যে পাঠক অরণ্য ভালবাসে,ভালবাসে পাহাড়ের গল্প তার কাছে এই লেখা মনোহর হবে।
ট্রেইলে ফিরি এবার। শীত শেষে বসন্তের প্রাক্কালে কুয়াশা মণ্ডিত এক সকাল হলো ঝিড়ির পাশের ম্রো পাড়াটিতে। ঝিড়ির পাশে হওয়ায় শেষ রাতে ঠান্ডা অনুভূত হয়েছিল অনেক। ইতোমধ্যে আমরা আমাদের প্ল্যান থেকে দুই দিন পিছিয়ে পড়েছি। পরিকল্পনার সময় অভিযানের এই অংশের নাম দেয়া হয়েছিল ‘Puzzle of Nga Hung’, কিন্তু তিন দিন পিছিয়ে থেকেও ঙা হুং-এর পাজল আমরা সমাধান করতে পারছি না এখনও। এরকম মুহূর্তে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে অনেক সময়। যার প্রভাব পড়ে দলের অন্যান্য সদস্যদের উপর।
‘প্ল্যান এ’ বিফল হয়ে, ‘প্ল্যান বি’ অনুসরণ করবো আমরা এখন।মাঝে হারিয়েছি মূল্যবান তিনটি দিন। অভিযানের নেভিগেশনের দায়িত্ব আমার হওয়ায়, আমি আলাদা একটি চাপ অনুভব করছি। জানি আমাকে এখন শান্ত হয়ে যেতে হবে।
আমাদের ছয় জনের অভিযাত্রী দলের কেউই ‘ঙা হুং’ পাহাড়ে আরোহণ করেনি।অর্থাৎ আমাদের চেনা গণ্ডির শেষ এখানেই। সাথের একজন ম্রো বন্ধুর ছোটবেলার কিছু স্মৃতি,পাহাড়ে নেভিগেশনে ম্রোদের সহজাত দক্ষতা,টপোগ্রাফিক ও স্যাটেলাইট ম্যাপ নিয়ে আমাদের পড়াশোনা,সেই ভিত্তিতে বাসায় বসে কম্পিউটারে বানানো কিছু জিপিএস ট্রেইল,বুনো প্রকৃতি সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞান আর অফলাইন নেভিগেশনের দুইটি অ্যাপ। এগুলোকে পুঁজি করে পাড়া থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আগামী দুই দিন আমরা কোন মনুষ্য বসতির দেখা পাবো না।
এ ঝিড়ি ও ঝিড়ি হয়ে পূর্বদিকে যতদূর এগিয়ে যাওয়া যায়, তারপর ঝিড়ি ছেড়ে কোন বন্যপ্রাণীর ট্রেইল অনুসরণ করে রিজের উপর উঠে যাব, ওয়ালি তং-কে পশ্চিমে রেখে দক্ষিণে এগিয়ে যাব, মোটাদাগে এই হল পরিকল্পনা। প্রায় সাত বছর আগে এখানে একটি পাড়া ছিল, এখন আর নেই, পুরনো পাড়ার ট্রেইলটা ধরার ইচ্ছে। আমার ম্রো বন্ধুটির মামা বাড়ি ছিল এখানে, ছোট বেলায় অনেক দিন কাটিয়েছেন এই পাহাড়ে। পাড়া উঠে যাওয়ার পর আর কখনও এই পথ মাড়ায়নি সে।
পাড়া উঠে যাওয়ার পিছনে অনেকগুলো কারণই থাকতে পারে। ঐতিহ্যগত ভাবেই ম্রোরা আধা যাযাবর জীবন পরিচালনা করে থাকে। রিসোর্সের উপর ভিত্তি করে বসবাসের স্থান পরিবর্তন করে। রিসোর্স বলতে সারা বছরের বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ,জুম চাষের জন্য উর্বর জমি,শিকারের প্রাচুর্যতা ইত্যাদি। এছাড়াও সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় কিছু রাজনৈতিক কারণও এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে আশ্চর্যের বিষয় যে এই অংশে রিজের উপরে থাকা দুটি পাড়ার মানুষই অজানা কারণে স্থানান্তরিত হয়ে গেছেন পাড়া ছেড়ে।
সঙ্গী ম্রো বন্ধুদের সাথে গল্পে গল্পে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। ম্রোদের সাথে পাহাড়ে হাঁটার সব চেয়ে বড় লাভ হল এই অরণ্য সম্পর্কে ওদের যে গভীর জ্ঞান, যা তারা বংশানুক্রমে জেনে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই জ্ঞানের কিছুটা ভাগ নেয়া যায়। কোনটা কোন প্রাণীর ছাপ,তাঁদের ব্যবহার,কোন গাছ বা লতাটি কি কাজে লাগে ইত্যাদি শেখার এক সুবর্ণ সুযোগ এটি।
বড় ঝিড়ি ছেড়ে একসময় অন্য আরেকটি ঝিড়ি ধরলাম।একটু এগিয়ে পেলাম একটি জলপ্রপাত।চারিদিকে বন্য প্রাণীদের চলাচলের ছাপ,ঝিড়িতে গয়ার, বুনো শুকর, ছোট ও বড় সাইজের হরিণের পায়ের তাজা ছাপ, গাছে গাছে ভাল্লুকের নখ আঁচড়ানোর দাগ। বুঝতে পারলাম যে এদিকটা বন্য প্রাণীদের প্রাকৃতিক অভয়াশ্রম।সামনে আরো কিসের কিসের দেখা মিলবে তা ভেবে রোমাঞ্চ অনুভব করছি।
আরো একটি জলপ্রপাত টপকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছি। ঝিড়িটা এখানে একটি গিরিখাতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে।একটি প্রায় ৬/৭ হাত লম্বা সাপ (Indo Chinese Rat Snake, ptyas korros)ব্যাঙ ধরার চেষ্টায় আছে,কতক্ষণ সময় তাকে দেখেই কেটে গেল। এছাড়াও ট্রেইলে প্রায় একটু পর পর দেখা মিলছে আরেক প্রজাতির সাপের, লালগলা ঢোড়া (Red Necked Keelback, rhabdophis subminiatus)যেটি একই সাথে বিষাক্ত ও বিষধর। তবে মোটেও আক্রমণাত্মক না এরা, আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে নিজে থেকেই নিরাপদ দূরত্বে সরে যাচ্ছে। সাপ থাকতে পারে এমন ট্রেইলে ট্রেকিং এর সময় কিছু নিয়ম অনুসরণ করা উচিত, তাঁর মধ্যে একটি হল প্রতিটি স্টেপ একটু শক্তির সাথে মাটিতে ফেলা। এতে কম্পনের সৃষ্টি হয় এবং সাপ সরীসৃপ প্রাণী বিধায় আগে থেকে কম্পন টের পেয়ে সরে যায়।
দুপুর যখন শেষ হয় তখন আমরা ঝিড়ি ছেড়ে পাহাড় বেয়ে উঠা শুরু করলাম।এ পথে হরিণেরা পানি খেতে ঝিড়িতে আসে,সেটি অনুসরণ করে উপরে উঠছি আমরা। বনের মাঝেও এক ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। ঝোপঝাড়ের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, বাড়ছে বড় বড় গাছের সারি। এই ভর দুপুরের কড়া রোদেও বনের ভিতরে আলো পড়ছে না তেমন। একসময় উঠে এলাম রিজের উপরে। জায়গাটি অনেকটা পাহাড়ের উপর সমতল মেসার (mesa) মত। আরেকটু হেঁটে বনের মধ্যে একটি ফাঁকা জায়গা দেখা গেল, এখানেই ছিল পাড়াটি। সাত বছরে প্রকৃতি দখল করে নিয়েছে তার সম্পত্তি, আজ আর কোন অস্তিত্ব নেই সেই পাড়ার।
হাতে সময় কম, এমনিতেও পাহাড়ি অঞ্চলে হুট করে সন্ধ্যা নামে। শীতের মৌসুম হওয়ায় ঝিড়িগুলো শুকনো,একটি গিরিখাতের মধ্যে চুইয়ে চুইয়ে এসে পানি জমছে,সেই পানি দিয়ে পিপাসা মেটালাম আমরা,রাতের খাবার রান্না করা হল।আজ আর সামনে যাওয়ার ইচ্ছে নেই,পানির সোর্স ফেলে যাওয়াটাও নিহায়েত বোকামি হবে।একটু পিছিয়ে মোটামুটি সমতল এক জায়গা দেখে আমরা তাঁবু ফেললাম,রাতের ক্যাম্প-ফায়ারের জন্য জ্বালানি যোগাড় করা হল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে,সব কিছু গুছিয়ে আমরা আগুনকে ঘিরে বসলাম। দিনের বেলা যে বন ছিল নিশ্চুপ,সেই বন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে এখন।সহস্র বছরের আদিমতায় পূর্ণ সেই অরণ্যে রাত্রির আগমনী বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে!
এই রাতটি নিয়ে আমি আরো কয়েক পৃষ্ঠা লিখে যেতে পারবো,আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতের তালিকা করলে নিঃসন্দেহে এটি একদম উপরের দিকে থাকবে। রাতের অরণ্য যে এতটা জীবন্ত হতে পারে আমার কোন ধারণাই ছিল না। অবাক বিষ্ময়ে ভাবছি এখনও কতটা সমৃদ্ধ রয়েছে এই সুপ্রাচীন বনটি। ৫০-৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে টারশিয়ারি যুগে ইন্ডিয়ান প্লেটের সাথে এশিয়ান মেইন ল্যান্ডের ধাক্কায় হিমালয় পর্বত উথিত হওয়ার সময় সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় সারির এবং ধীরে ধীরে সৃষ্টি হতে থাকে এই বনের। টারশিয়ারি যুগকে ম্যামেলদের যুগও বলা হয়।এরপর শুরু হয় কোয়াটার্নারি যুগ। এটির দুটি ভাগ প্লাইস্টোসিন ও হলোসিন। প্লাইস্টোসিন কালের শুরু ২.৫৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে শুরু হয়ে শেষ হয় ১১.৭ হাজার বছর আগে। এ সময়কে বলা হয় বরফের যুগ । ১১.৭ হাজার পূর্বে শুরু হয় হলোসিন যুগ যা এখন বর্তমান।
রাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে নানা নিশাচর প্রাণীদের ডাক শুনতে পাচ্ছি, স্নায়ুর ওপরও চাপ পড়ছে। সাথের ম্রো বন্ধুরা পরামর্শ দিল আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হবে সারারাত, পালা করে ঘুমোতে হবে। ম্রো’রা সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী, ভুত প্রেতে তাঁদের দারুণ ভয়। আগুন শুধু উষ্ণতাই বিলোচ্ছে না,একই সাথে দিচ্ছে নির্ভরতা ও নিরাপত্তা। আত্মবিশ্বাস এর নিভু নিভু সলতে আবার প্রজ্বলিত হয়ে উঠছে।এটুকু আগুনের এত শক্তি বিশ্বাস করা দায় অথচ আগুন সেই গুহাযুগ থেকেই মানুষকে আগলে রেখেছে বুনো প্রকৃতি থেকে।
আমার এখন দুই ধরণের অনুভূতি হচ্ছে,যা আবার একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক।একবার নিজেকে মনে হচ্ছে অবাঞ্ছিত শহুরে আগন্তুক,যার এখানে আসার অধিকার নেই। শুধু এই অরণ্য নয়, পৃথিবী জুড়ে সব অরণ্যের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে, কার জন্য? মানুষের জন্য,আমার নানাবিধ চাহিদার জন্য। উন্নয়নের চাহিদা, সম্পদের চাহিদা, আয়েশের চাহিদা, রাজনৈতিক চাহিদা, উফ এই মানুষ প্রজাতির চাহিদার কোন শেষ নেই। কিন্তু অরণ্যের? অরণ্যের যোগানের তো শেষ আছে। হাজার হাজার বৃক্ষরোপণ করেও কি আমরা এমন একটি অরণ্য ফিরে পাব?
আবার সাথে সাথেই মস্তিষ্কের একটি অংশ বিদ্রোহ করে বসছে। চিৎকার করে বলছে এ অরণ্যই আমার ঘর,আমার মত প্রাইমেটের এখানের অধিবাসী হওয়ারই কথা ছিল। পূর্বপুরুষের ভুলের শাস্তি আমি আমার মননকে কেন দিব? আমার পুরো শরীর মন এই বনে বেঁচে থাকার জন্যই বিবর্তিত হয়েছিল। আজ আমরা অরণ্য ছেড়ে ইট পাথর সিমেন্টে বসবাস করা শুরু করেছি, তাই বলে কি নিজের শিকড়কে ভুলে যাব? নির্মূল করে ফেলব আমাদের আদি নিবাস? এর উত্তর আমি জানি না,মানবগোষ্ঠীই হয়তো জানে না।
আমার পাহারা দেয়ার পালা শুরু হল রাত দুটো থেকে। আমি আর কং ইয়েঙ। ইচ্ছে করেই এই সময়টা বেছে নিয়েছি, নিশাচর প্রাণীদের বাড়ি ফেরার আর দিবাচরদের ঘর ছাড়ার মুহূর্তটুকু উপভোগ করতে চাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই কং ঘুমিয়ে গেল বসা অবস্থায়। আমার সাথের পাঁচটি মানুষের অস্তিত্ব আমি আর অনুভব করছি না, আবার নিঃসঙ্গও লাগোছে না। আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য জেগে আছে চিম্বুক, দ্য ওল্ড লেডি।
স্থানীয় ম্রোদের কাছে এই অরণ্যের প্রাণীদের অনেক গল্প শুনছি কয়েক বছর ধরেই। ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্স(সিসিএ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই অঞ্চলের বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করে।এই অরণ্যের নানা জায়গায় তারা ক্যামেরা ট্র্যাপিং করেছিল, সেখানেও উঠে এসেছে এই অরণ্যের বাসিন্দাদের ছবি।তাদের ওয়েবসাইট আর ফেসবুক পেজে দেখা ছবিগুলো আর ম্রোদের থেকে শোনা নানান শিকার কাহিনীগুলো এখন কল্পনায় আসছে।কি নেই এখানে, কয়েক প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় বনবিড়াল থেকে শুরু করে দুষ্প্রাপ্য হনুমান,বানর,উল্লুক,হরিণ,মেঘলা চিতা,ভাল্লুক আরো কত কি ! সম্ভবত বাঘও আছে।
পাখিদের জন্য এই বন নির্ভরযোগ্য আশ্রয়,আশেপাশে মানুষের বসতি না থাকায়, এখানে শিকারির হাতে প্রাণ হারানোর ভয় নেই। চিম্বুকের বাসিন্দাদের প্রাকৃতিক অভয়াশ্রম এটি। এত ছোট বনে এতগুলো বৈশ্বিকভাবে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি একসাথে বাস করে, পৃথিবীর আর কোন স্থানে এমন বন আছে বলে মনে হয় না। মানুষের ক্ষুধা আর সর্বগ্রাসী উন্নয়নের আগ্রাসনে আর কত দিন এরা টিকে থাকবে এই প্রশ্নকে আপাতত মনে স্থান দিয়ে বর্তমানের সুখানুভূতিটুকু আমি নষ্ট করতে চাচ্ছি না। এখন আফসোসের সময় না আমার, এখন আদিম বন্য আমিকে খুঁজে ফেরার সময়।
চিম্বুকের আরেক বাসিন্দা কং ইয়েঙ জেগে উঠেছে, বসে ঘুমিয়ে ঠিক আরাম হচ্ছে না এখন তার। তাঁবু থেকে একটা স্লিপিং ম্যাট এনে আগুনের পাশে বিছিয়ে, আমাকে শোয়ার জন্য ডাকলো। কং ইয়েঙ এর পূর্বপুরুষরা অর্থাৎ ম্রো’রা চিম্বুকের আদি বাসিন্দা। মায়ানমারের কালাডান নদীর উপত্যকায় ছিল তাঁদের বসবাস। সেখানের বসবাসকারী আরেক জাতিগোষ্ঠী খুমীদের সাথে অনেক বছর ধরে যুদ্ধ চলছিল ম্রো’দের। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে হেরে গিয়ে তারা সরে এসেছিল শঙ্খ আর মাতামুহুরী নদীর উপত্যকায়, মনুষ্যহীন একটি রেইনফরেস্টের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, এই অরণ্যকেই বানিয়ে নিয়েছে নিজেদের আবাসভূমি। ঠিক কখন ম্রো’রা শঙ্খ আর মাতামুহুরীর উপত্যকা ও চিম্বুক পাহাড়ে বাস করা শুরু করেছে তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে মত পার্থক্য রয়েছে, তবে তা ৬০০ থেকে ৪০০ বছরের মধ্যে।
ভোরের দিকে আর চোখ খোলা রাখতে পারছি না, একটু ঘুম দরকার আমার। আগুনে কিছু লাকড়ি চাপিয়ে দিয়ে কং এর পাশে শুয়ে পড়লাম, এক হাত দিয়ে কং আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। চিম্বুকের ভালোবাসা, তার বাসিন্দাদের ভালোবাসায় গুণমুগ্ধ আমি প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘন্টাখানেক ঘুমের পর উঠলাম,ইতোমধ্যে সবাই উঠে পড়েছে। পানির একমাত্র সোর্স ঐ গিরিখাতের জমানো পানি শুধু আমরা না, এই মেসার সব প্রাণী এবং আমার মত আগন্তুকরা এই পানির উপরই যে নির্ভর করে তার কিছু চিহ্ন আগের দিনই পেয়েছিলাম। গিরিখাত থেকে খাওয়া আর রান্নার পানি আনতে গেলাম। ঝিড়িতে একটি ছাপ দেখিয়ে কং বললো মেঘলা চিতা গেছে একটু আগে। ছাপ দেখে আসলে অনেক কিছুই বলে দেয়া যায়,তবে ঐ চোখ সবার থাকে না।
ক্যাম্পসাইটে এসে শুনি আরেক ম্রো বন্ধু,প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ভাল্লুকের মধু খোঁজার চিহ্ন দেখে এসেছে, গত রাতেই আমরা তার শব্দ শুনেছিলাম। মাথার উপর উড়ন্ত কাঠবিড়ালিরা লাফ দিয়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাচ্ছে, পাখিদের কলরবে পুরো বন মুখরিত। নাশতা আর কফি পর্ব শেষ করে আমরা আবার ট্রেইলে নামলাম। আজ আরো দক্ষিণে যাব, সম্ভব হলে আজই ‘ঙা হুং’ আরোহণে যাবে আমাদের ছোট অভিযাত্রী দলটি।
দক্ষিণে কিছুদূর যাওয়ার পর বড় গাছের বন শেষ হয়ে শনের ঝোপঝাড় শুরু হল।বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পাড়ার বাসিন্দারা জুম চাষের জন্য জঙ্গল কেটেছিল, তাই এ অবস্থা।এর মাঝে দিয়ে জন্তুদের চলার ট্রেইল ধরে এগোচ্ছি।আমার ম্রো বন্ধুটি সামনে, আমি তাঁর ঠিক পেছনে। এই অভিযানে আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু হাতে কলমে শিখেছি, কিভাবে সবচেয়ে কম কষ্টে ট্রেইল বানাতে হয়,খাড়া কোন গিরিখাত কিভাবে এড়িয়ে আবার ট্রেইলে ফিরতে হয় ইত্যাদি।
একজন শিকারী ম্রো-এর সাথে পাহাড়ে হাঁটার মজাই আলাদা। কোন কিছুই তাঁর নজর এড়িয়ে যায় না। নজর এড়াবেই বা কিভাবে! হাঁটার সময় তাঁদের চোখ সাবমেরিনের পেরিস্কোপের মত চারিদিকে ঘুরতে থাকে। কোন গাছে কি ফল, এই ফল খেতে কোন প্রাণী এই গাছে উঠেছে চিহ্ন দেখেই একজন শিকারী বলে দিতে পারে। আমার জন্য এটি ছিল একদম প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের মত, নিজের পুঁথিগত বিদ্যাকে ঝালিয়ে নেয়ার এই সুযোগ আমি বা আমরা একটুও হাতছাড়া করিনি।
আবার বড় গাছের বন শুরু হল। এই ধরণের চিরসবুজ বনে জারুল, গামার, কান্দেব, তেলসুর, পীতরাজ, বার্মিজ সেগুন, চুক্রাশি ইত্যাদি কাঠের গাছ রয়েছে। এছাড়াও তৃণভোজী প্রাণী আর পাখিদের জন্য রয়েছে নানা রকমের ফল গাছের সমাহার। রাতের বেলা যেই বন এত জীবন্ত ছিল, সেই বন এখন আশ্চর্যরকম নীরব। দিনের বেলায়ও কি রকম অন্ধকার আর ভূতুড়ে লাগছে এই বনকে।
হঠাৎ শিকারী বন্ধুটি হাত তুলে একটি গাছের ডাল দেখিয়ে বললো, দাদা দেখো ভাল্লুকের বাসা, সান বেয়ার (Helarctos malayanus)। ভাল্লুকের প্রজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হয় এরা, ওজনে ২৫-৬৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। মোটাদাগে প্রায় সব ভাল্লুক গাছে চড়তে পাড়লেও, সান বেয়ার হচ্ছে আরবোরিয়াল অর্থাৎ এরা গাছে বাসা বাঁধে এবং গাছেই ঘুমায়। সান বেয়ার ছাড়াও আরেক প্রজাতির ভাল্লুক এই বনে বিচরণ করে, এশিয়ান শ্লথ বেয়ার (Melursus ursinus)।
একটি তথ্য শেয়ার করি এই ভাল্লুকদের নেচার নিয়ে। এরা কিন্তু মধু খেয়ে নেশা করে । গাছের শিকড়ের সাথে মাটির ভিতরে একদল মৌমাছিরা বাসা বাঁধে। যে মৌচাকের মধু কিছুটা টক স্বাদের হয়ে থাকে। মাটি খুঁড়ে এই মধু ভাল্লুকেরা বের করে এবং অত্যধিক সেবনের ফলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ম্রো বন্ধুটি ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছে যে আমার আর রাসেল ভাইয়ার বন্যপ্রাণীর প্রতি মারাত্মক আগ্রহ। তাই দাদাও আমাদের মত মনযোগী ছাত্র পেয়ে তাঁর জ্ঞান ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিচ্ছে।
কিন্তু এই অরণ্যের ভবিষ্যতের কথা মনে পড়তেই এই সুখানুভূতিগুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আর কয়েক বছরের মধ্যেই এ বনের মাঝ দিয়ে রাস্তা যাবে। কথিত নিরাপত্তা ইস্যুতে রাস্তা হলেও এর ফলাফল যে কতটা ভয়ঙ্কর হবে তা সহজেই অনুমেয়। বনখেকোদের অর্গাজম হবে এই বনের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে, রাস্তার নাম করে দেদারছে কাটা হবে শতবর্ষী মাতৃবৃক্ষ, যতটুকু না দরকার তাঁর চেয়ে অনেক অনেক বেশী।
পুরো বান্দরবান জুড়ে রয়েছে এর অসংখ্য প্রমাণ। যেমন, থানচি-আলিকদম রাস্তা হওয়ার পর ক্রিসতাং পাহাড়ের বন উজাড় হয়ে আজ সিকিভাগও নেই। একই অবস্থা হয়েছে মিরিঞ্জার বনের। শুধুমাত্র এক পোয়ামুহুরী রাস্তাই শেষ করে দিল। আলীকদম-থানচি, বান্দরবান-থানচি, আলীকদম-পোয়ামুহুরী, বান্দরবান-রুমা, বান্দরবান-রোয়াংছড়ি এই রাস্তাগুলো দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করবেন, একটি শতবর্ষী মাতৃবৃক্ষও নেই আজ। যে গাছগুলো আছে সেগুলোর কাঠ ব্যবহারের অযোগ্য। ওল্ড লেডির অবস্থা এরকম হওয়ার আশঙ্কায় নিমেষেই মন খারাপ হয়ে গেল।
ফিরে আসি বর্তমানে, জিপিএস এসআরটিম ম্যাপে আমাদের অবস্থান দেখাচ্ছে একটি চূড়ার একদম কাছে। শিকারী বন্ধুটি বলে উঠলো এটিই ‘ঙা হুং’। কিন্তু আমি জানি এই চূড়াটি ‘ঙা হুং’ নয়। ম্যাপ বলছে আমরা ওয়ালি তং এর দক্ষিণ পূর্বে প্রায় সমান্তরাল একটি পাহাড়ে আছি। ঙা হুং আরো দক্ষিণে আরো কয়েক শ ফিট উঁচু। বন্ধুকে বুঝিয়ে বললাম, আমাদের বানানো ট্রেইল আর বন্য প্রাণীর ট্রেইল, এই দুটোর সমন্বয় করে আগে বাড়লাম আমরা। এই পাহাড় থেকে কিছুটা নেমে তারপর ‘ঙা হুং’ এর রিজ ধরে আবার উঠতে হবে।
রিজের কাছাকাছি এসে পেয়ে গেলাম বন্যহাতির ট্রেইল। এশিয়াটিক এলিফ্যান্ট (Elephas maximus) যেটি মায়ানমারের ঙা হাং খাল থেকে উঠে এসেছে। এই এশিয়াটিক এলিফ্যান্ট তাঁদের আফ্রিকান জাত ভাইদের মত বিশাল আকৃতির না হলেও ভূমিতে এরা এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রাণী। ঐ যে দেখা যাছে ওয়ালি তং এর দক্ষিণ পূর্ব ফেইস আরো কিছুটা পশ্চিমে কংসু তং।এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে।সব ভুলে মুগ্ধ হয়ে পাহাড় দেখছি আমরা ছয়টি প্রাণ।এই মুগ্ধতাকে আরো বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে বিপন্নপ্রায় ও দুষ্প্রাপ্য চারটি রাজধনেশ বা গ্রেট হর্নবিল (Buceros bicornis)আমাদের আই লেভেলে উড়তে শুরু করলো। খেলছে তাঁরা একে অপরের সাথে;কখনো আবার গাছে বসে ফল খাচ্ছে।সব কিছু মিলিয়ে এত স্নিগ্ধ পরিবেশ আবার একই সাথে আদিম ও বুনো, যা আমাদের সময়জ্ঞান গুলিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
রিজের এই অংশটুকু সরু,তার উপর বাঁশের ঝাড় জন্মে আছে। হাতির ট্রেইল না থাকলে ভোগান্তি যে কি পরিমাণ হতো তা আর ভাবতে চাচ্ছি না। তবে কিছুক্ষণ পর রিজ আবার চওড়া হয়ে গেল, আবারও বড় গাছের বন। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে মদকের সর্বশেষ বিন্দু ঙাসাই হুং-বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণ পূর্ব কোণ।
প্রচুর ক্লান্ত আমরা। সকালের নুডলস কফি আর মাঝে কিছু ড্রাই ফুডস ছাড়া পেটে ভারী কিছু পড়েনি। এমনকি সাথের পানির যোগানও প্রায় শেষের পথে, হিসেব করে পানি পান করতে হচ্ছে। সাথের ম্রো’বন্ধুরা এক সময় হাল ছেড়ে দিল, তাঁদের কাছে মনে হচ্ছে অলীক কিছুর পিছনে যেন ছুটছি আমরা।
এসআরটিম বলছে চূড়ার প্রায় কাছে চলে এসেছি আমরা,অগ্যতা বাবু ভাইয়া আর তাহমিদ ভাইয়ার উৎসাহে ব্যাগগুলো ম্রো-বন্ধুদের কাছে রেখে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে আগে বাড়লাম। পিঠে ব্যাকপ্যাক না থাকায় হালকা চালে দৌঁড়ানো শুরু করলাম, উত্তেজনাও কাজ করছে খুব। একে একে আমরা চারজন উঠে আসলাম চূড়ায়। প্রথম ও বড় চূড়াটিতে। ভালো মত সিউর হয়ে নিলাম যে টপোগ্রাফিক ম্যাপের হায়েস্ট পয়েন্টে আমরা হিট করেছি কি না!জিপিএস ডিভাইস বের করে তাহমীদ ভাইয়া রিডিং নিচ্ছে।পুরো অভিযান জুড়েই আমাদের মনে সন্দেহ ছিল যে উচ্চতা ২৫০০ ফিট ক্রস করবে কি না, এই নিয়ে অল্প বিস্তর গঠনমূলক তর্কও হয়েছিল। অবশেষে যখন ২৫২৯-২৫৩৮ ফিটে এসে স্থির হল রিডিং, আমার খুশি দেখে কে!
কিছু ছবি তুলে ফিরতি পথ ধরলাম। উত্তেজনা চলে যাওয়ায় ক্লান্ত অনুভব করছি।এদিকে পানির সোর্স খুঁজে বের করতে হবে।রাতের ক্যাম্পিং সাইট খোঁজাও বাকি।হাতির নেমে যাওয়ার ট্রেইল দেখে আমরাও চিম্বুকের পূর্বদিকের ঢাল ধরে নেমে যাচ্ছি। তাহমীদ ভাইয়া আর বাবু ভাইয়া যেনো দৌড়াচ্ছে। আলো কমে আসছে দ্রুত। এই কথা জানানোর জন্য পিছনে পড়ার কোন মানে হয় না। আমিও গতি বাড়ালাম।
শুকনো ঝিড়ি ধরে নামছি আমরা,ঝিড়ির গর্তগুলোতে জমাট পানি পেয়ে মন খুশি হয়ে গেল,যাক অন্তত রাতে কিছু পেটে পড়বে।তবে এই পানির ভাগ শুধু আমাদের না,বনের অন্য প্রাণীদেরও।হাতির মল আর ছাপ,হরিণের (Muntiacus muntjak)পায়ের ছাপ রয়েছে,আরো আছে গয়্যার (Bos gaurus)এর ছাপ।
গয়্যার হচ্ছে একধরণের বন্য গরু, একে ইন্ডিয়ান বাইসনও বলা হয়।এরা Bovidae ফ্যামিলির সর্ববৃহৎ প্রাণী।Bovidae হচ্ছে এমন সব প্রাণীদের একটি বায়োলজিক্যাল ফ্যামিলি যাদের পায়ের খুর দুই ভাগে দুটি করে আঙুলে বিভক্ত। এই ফ্যামিলির অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে বাইসন,আফ্রিকান বাফেলো, মহিষ, গরু, এন্টিলোপ, ভেড়া ইত্যাদি।প্রায় ২০ মিলিয়ন বছর আগে এই পরিবারের প্রথম প্রাণিটির উদ্ভব হয়েছিল।বিচরণের জায়গা কমে আসা অর্থাৎ বন উজাড় ও অত্যধিক শিকারের ফলে গয়্যারও আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
অবশেষে দেখতে পেলাম,বাবু ভাইয়া আর তাহমীদ ভাইয়া থেমেছে,কি যে শান্তি লাগলো এই দৃশ্য দেখে তা লিখে বুঝাতে পারবো না।বিশাল এক জলপ্রপাত আজকের মত থামিয়ে দিল আমাদের।তাঁবু ফেলা হল,রাতের খাবার রান্না হচ্ছে।চিম্বুকের বুকে আরেক সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেললাম আমরা।
আজ সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে,আমি আর তাহমীদ ভাইয়া আগুনের পাশে বসে রয়েছি শুধু।এই মানুষগুলো থেকে অনেক কিছু শিখেছি আমি।এই অভিযানের অন্যতম বড় পাওনা এটিও।রাসেল ভাইয়া পাহাড় সম্পর্কে বিস্তর ধারণা রাখেন, আমাদের পাহাড়ের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে শুরু করে উনার দেখার চোখ, কতশত প্রশ্ন যে ভাইয়াকে করেছি তাঁর কোন ইয়ত্তা নেই। তাহমীদ ভাইয়া আর বাবু ভাইয়া থেকে বেশী শিখেছি মনের জোর কি করে ধরে রাখতে হয়,এই দুইটি মানুষ আশ্চর্য রকম শক্তিশালী মনের দিক দিয়ে।ম্রো বন্ধুদের কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে প্রকৃতির সাথে মানিয়ে তাঁকে বশে আনতে হয়,কিভাবে নম্র হয়ে থাকতে হয়।
ওল্ড লেডির বুকে আজ আমাদের শেষ রাত।আমার শরীর ক্লান্ত, মন কিছুটা বিষণ্ণ।এই আগুনের পাশে বসেই ভাবছি আবার আসতে হবে এই অরণ্যে, ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্বে আমি এর সবটুকু দেখতে চাই, আদিম বন্য এক আমিকে খুঁজে পেতে এখানে আমার আসতেই হবে।এই অরণ্য আমার ভেতরে অন্য এক আমি’র জন্ম দিয়েছে।
আগামীকাল চিম্বুক থেকে নেমে শঙ্খ পেড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আমাদের,সাথের ম্রো বন্ধুরা কাল বিদায় নিবে।আমাদের রাস্তা হয়ে যাবে ভিন্ন। মদকের একটি চুড়া, ‘তানখানাই তং’ আরোহণের চেষ্টা করবো আমরা।সেই গল্প আজ না,অন্য আরেকদিন করা যাবে।এই গল্পটি শুধুই অপার্থিব লাবণ্যময়ী বুনো চিম্বুকের,দ্য ওল্ড লেডির।বয়সের ভাড়ে ন্যুজ্ব হয়েও যে পরম মমতায় আগলে রেখেছে তাঁর সন্তানদের। The old lady is still alive.তবে আর কত দিন এই প্রশ্নটি রয়েই যাচ্ছে।