চিটাগাং বাইসন । যা আমরা গয়াল নামেই চিনি। পার্বত্য অঞ্চলে এখন গৃহপালিত পশু হিসেবে একে দেখা যায়। মূলত গয়াল বন্যগরুর একটি প্রজাতি। গয়ালের বৈজ্ঞানিক নাম: Bos frontalis। ভারতে এরা মিথুন/মিঠুন নামে পরিচিত।
বন্য গয়াল দলবদ্ধভাবে বাস করে। দলের নেতৃত্বে থাকে একটি বড় ও শক্তিশালী ষাঁড়। সাধারণত, ১০-১১ মাস গর্ভধারণের পর স্ত্রী গয়াল একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। গয়াল বাঁচে ১৫-১৬ বছর।
গয়াল তৃণভোজী। এরা সাধারণত হাতির সহবাসী। গহিন বনের যেখানে ছোট ছোট ঝোপের কচিপাতা ও ডালপালা আছে তেমন জায়গা গয়ালের বেশ পছন্দ। শক্ত ও কর্কশ ঘাস খাওয়ায় এদের দাঁত দ্রুত ক্ষয় হয়। এই ক্ষয় পূরণে জন্য এদের ক্ষার ও লবণযুক্ত মাটি খেতে হয়। অন্ত্রের পোকা কমানোর জন্যও এরা লবণ খায়।গয়ালের এই অভ্যাসের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে লবণের টোপ ফেলে গয়াল ধরা হয়।
বুনো মোষ, গাউর ও গয়াল বাংলাদেশে গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক পর্যন্ত পাওয়া যেত। বুনো মোষ বিলুপ্ত হয়েছে। গৌর বা গাউর কদাচিৎ বাংলাদেশ মায়ানমার সিমান্তের দেখা যায়। বাংলাদেশ, ভারত, ভূটান, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও চীনে গয়াল দেখতে পাওয়া যায়। চীনে এরা দুলং গরু নামে পরিচিত। গৌর বন্য গরুর সবচেয়ে উঁচু প্রজাতি।মালয় বনগরুকে সেলাদুং এবং বর্মী বনগরুকে পাইউং বলা হয়। গৌরের গৃহপালিত জাতকে গয়াল বা মিঠুন বলে। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাবলাখালি, সাজেক ও মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন পাহাড়ি বনে গয়ালের বিচরণ রয়েছে। মাত্র কয়েক দশক আগেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট এবং গারো পাহাড় সংলগ্ন ময়মনসিংহের বনাঞ্চলে প্রচুর গয়াল ছিল। অবাধে শিকার আর বাসযোগ্য ভূমি হ্রাসের কারণে বন্য গয়াল এখন মহাবিপন্ন ।
অধ্যাপক আ ন ম আমিনুর রহমান এর মতে ( বিভাগীয় প্রধান, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্র, গাইনিকোলজি, অবস্টেট্রিক্স অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ বিভাগ, বশেমুরকৃবি, সালনা, গাজীপুর ) ‘বনগরু বান্টেং (Bos banteng) বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৫৫ থেকে ৬৫ বছর আগে। অনেকেই জানেন, এদেশের আরেক প্রজাতির বনগরু অর্থাৎ গাউর (Bos gaurus) হারিয়ে গেছে। এক সময় উত্তরের শালবন থেকে টেকনাফ পর্যন্ত চিরসবুজ বনে এরা বিচরণ করত। জানা যায়, সর্বশেষ গাউরটি ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে মারা পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গাউর বিলুপ্ত হয়নি, এরা এখনও টিকে আছে বান্দরবানের গহিনে সাঙ্গু-মাতামুহুরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। তবে সংখ্যায় এরা নগণ্য এবং মহাবিপন্ন তালিকায়। বর্তমানে পাহাড়ে যে প্রজাতিকে অনেকে বনগরু বলে আসলে সেটা হল গয়াল। ’- প্রকাশ- যুগান্তর।
গয়াল বন্যগরুর একটি প্রজাতি কি না, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এরা কোনো বিলুপ্ত প্রজাতির বন্যগরুর পোষা বংশধর বা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের পোষা গরু ও গৌরের সংমিশ্রণে সৃষ্ট সংকর গরু। যারা প্রজাতি হিসেবে গণ্য করেন, তাঁরা গয়ালের বৈজ্ঞানিক নাম Bos frontalis বলে উল্লেখ করেছেন। তবে গৃহপালিত গরু, বুনো মহিষ ও বিশেষত গৌরের বা গাউরের সাথে গয়ালের সুনিদির্ষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
গয়ালের দেহের গড়ন অনেকটা গাউরের মতোই; তবে আকার ও ওজন কম। মাথা তুলামূলকভাবে ছোট। পিঠের উপরের কুঁজ ছোট, কাঁধ থেকে পিঠের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। গলার চামড়ার ঝুল গাউরের থেকে বেশি থাকায় বাইসনের সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। এ জন্যই এদেরকে চিটাগাং বাইসন নামে ডাকা হয়। গৌরের দুই শিঙের মধ্যে ঢিবির মতো আছে, যা গয়ালের নেই। গৌরের শিং অপেক্ষাকৃত ছোট এবং ওপরের দিকে ভেতরমুখী বাঁকানো। গয়ালের শিং দুই পাশে ছড়ানো, সামান্য ভেতরমুখী বাঁকানো। শিঙের গোড়া অত্যন্ত মোটা।
গয়াল পোষ মানলেও গৌর পোষ মানে না। বাংলাদেশের 1974 সালের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় গয়াল প্রজনন খামার ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।
ছবি : লেখক।