“মানসিক প্রশান্তির জন্য ভ্রমণ” এই প্রবাদটি কয়েক বছর আগ পর্যন্ত আমাদের দেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। নিকট অতীতে মধ্যবিত্ত সমাজে এই প্রবাদটিকে বিলাসিতার সাথে তুলনা করা হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ বিপ্লব ঘটে গেছে। বর্তমানে আমাদের দেশের বিভিন্ন পেশা ও আয়ের মানুষ তার অবসর সময়ে ঘরে বসে না থেকে ছুটে যাচ্ছে পাহাড়, জঙ্গল কিংবা সাগর ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু হঠাৎ করেই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই ভ্রমণ কালচারটি আমরা কি সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পেরেছি?
আমরা ভ্রমণ করি সাধারণত সৌন্দর্য উপভোগ আর প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগের পরিবর্তে ময়লা-আবর্জনার স্তুপে গিয়ে পড়লে কিংবা ধ্বংসযজ্ঞের মহড়া দেখতে পেলে তা নিশ্চয়ই সবার মনেই গভীর ভাবনার সৃষ্টি করে।
পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ ও করণীয়ঃ
সাধারণ ভাষায় পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে বা পরিবেশের ওপর কোন ধরণের প্রভাব না ফেলে যে ভ্রমণ করা হয় তাকেই পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ বলা হয়। কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললেই আমরা খুব সহজেই পরিবেশবান্ধব ভ্রমন করতে পারি এবং সেই সাথে আমাদের প্রকৃতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। যেমন-
১) ভ্রমণের সময় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র ও খাবার-দাবার সঙ্গে করে নিয়ে যাই। যেমন- পানির বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট, স্যালাইনের প্যাকেট, চিপসের প্যাকেট, চকলেট ছাড়াও বিভিন্ন রকম প্লাষ্টিকজাতীয় ও অপচনশীল দ্রব্যাদি। সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া এসব অপচনশীল জিনিস ব্যবহার করে তা ভ্রমণস্থানে না ফেলে সঙ্গে করে নিয়ে আসা;
২) পাহাড়-জঙ্গল হলো বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বনের মধ্যে বন্য প্রাণী দেখলে আমরা পুলকিত হই! পাখির কিচির-মিচির শব্দ আমাদের চিত্তকে উদ্বেলিত করে। কিন্তু আবার সেই আমরাই বন্য প্রাণীর মাংস ভক্ষণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। বনে এসেছি অথচ হরিণের মাংস খাবোনা, পাখির মাংস খাবোনা এটা কি করে হয়! এই ধরণের বর্বর মানসিকতার পরিবর্তন করা;
৩) পাহাড় অথবা বন-জঙ্গলে গিয়ে কোন ভাবেই উচ্চস্বরে গান বাজানো বা হৈ-হুল্লোড় করা যাবে না। কারণ এ ধরণের আচরণের সাথে বন্য প্রাণীরা অভ্যস্ত নয় তাই প্রাণীরা ভয় পেয়ে আবাসস্থল ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। পর্যায়ক্রমে এরকম চলতে থাকলে এক পর্যায়ে সেই স্থানগুলোতে আর বন্যপ্রাণী বসবাস করে না, সুতরাং এ ধরণের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে;
৪) যে স্থানে ভ্রমণ করা হবে যেখানের জনপদ, তাদের কৃষ্টি-কালচার, আচরণগত পার্থক্য থাকতেই পারে। তাদের জীবনযাত্রার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে-এটা তাদের আবাসস্থল, আমরা ক্ষণিকের অতিথিমাত্র;
৫) পাহাড়ী জনপদগুলোতে কাজের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য কম। তাই মেয়েরা যেমন বাহিরের কাজ-কর্ম করে তেসনি ছেলেরাও সন্তান লালন-পালন ও গৃহস্থলি কাজ করে থাকে। এছাড়া, শহুরে মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদের সাথে অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় সুতরাং তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে কোন ধরণের কটুক্তি বা কুরুচিপূর্ণ আচরণ না করা। এটা কোন সুস্থ মানসিকতার পরিচয় বহন করে না;
৬) বন্যপ্রাণী কিংবা পাখির আবাসস্থল দেখতে গিয়ে তাদের কোনভাবেই বিরক্ত করা যাবে না;
৭) বিপন্ন প্রাণীর দাঁত, কচ্ছপ শেল, বিপন্ন প্রাণীর চামড়ার তৈরি কোন কিছু ক্রয় বা সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকতে হবে;
৮) কোন স্থানে ভ্রমণকালীন সময়ে কোন নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে লক্ষ্য করে ছবি তোলার আগে অবশ্যই তার অনুমতি নিতে হবে;
৯) অর্থপূর্ণ ভ্রমণের জন্য আপনি যেখানে যাবেন সে অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থা, সেখানকার রীতিনীতি, সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করুন এবং স্থানীয়দের সাথে আন্তরিকতার সহিত কথা বলুন। স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণ না পেলেও ক্ষিপ্ত হবেন না;
১০) আপনার ভ্রমণের প্রমাণস্বরুপ সেখানে কোন প্রকার অঙ্কন বা নিদর্শন রেখে আসবেন না। কারণ এটা প্রকৃতির উপর কৃত্রিমতার হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়;
সর্বপরি একথা বলা যায় যে মানুষ প্রকৃতির কাছে যাবে, তবে প্রকৃতি যাতে তার মতো করে সুন্দর থাকে সেই দায়িত্বটাও মানুষের হাতে।