গ্রীষ্মের শুরু। তপ্ত বৈশাখের তীব্র রোদ উপেক্ষা করে ছুটে চলেছি একটি খালের উৎস দেখার লোভে। তীর্থ দর্শন শেষে হাতে আরও বেশ কয়েকটা দিন বাকি। কি করি? ফিরে আসার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে অন্য আর একটা ঝিরি ধরে মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনে যাবার চেষ্টা শুরু হয়। ঝিরিটির নাম পাইয়্যা ঝিরি। ঝিরি পাহাড় ঝিরি এভাবেই পথ চলছি। পাইয়্যা ঝিরি ছেড়ে পাহাড় পথে বেশ খানিকটা পথ চলার পর আরও একটা ঝিরি পেয়ে যাই। মূলত এ ঝিরিটিই আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে। স্থানীয়রা একে ভাল্লুক ঝিরি নামে ডাকে।
স্বপ্লভাষী বন্ধুবৎসল কাঙই ম্রো আমাদের পথ দেখিয়ে দেবেন বলে সঙ্গী হয়েছেন। কাজটা উনি খুশি মনেই করছেন। পেশায় একজন জুম চাষী। এ সময়টা জুমের জমি তৈরির সময়, তাই জমি নির্বাচন ও জুম পোড়ানো শেষে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তেমন কোন কাজ থাকে না। এদিকে বৃষ্টির দেখা নেই। পঞ্চাশ ছুঁইছুই মানুষটিকে অনুরোধ করাতে তিনি সানন্দে রাজি হয়ে যান। ভাল্লুক ঝিরির উৎসের কাছ থেকে নিচের দিকে নেমে আসছি । ঝিরিটা এখানে ছোট ও জলের পরিমাণও কম। পথ চলছি আর ঝিরিটিও ধীরে ধীরে প্রসস্থ হচ্ছে, জলও বাড়ছে। বিষয়টা খেয়াল না করলে দৃষ্টিগোচর হবে না। ছায়াঘেরা বেশ শীতল একটা পথ। এমন গরমে এরকম পথের মায়া কেউ ছাড়তে চাইবে না। পথের মায়ায় মনকে ছুটতে দিয়ে আমরাও পা বাড়াই।
পথ চলতে চলতে কখন গহীনে হারিয়ে গেছি তার খেয়াল কে রাখে! ঝিরির দু’পাশ জুড়ে প্রমাণ আকারের গাছ আর ঝোপ-ঝাড়। ঝিরির গা ঘেষেই সরু পায়ে হাঁটা পথটি কখনও ঝিরির এপাশ, কখনও ওপাশ এভাবেই চলেছে। হঠাৎ কাঙইয়ের হাতের ইশারা। বাঁশের তৈরি তামাক খাবার হুকুটি থেকে ধুঁয়া ছেড়ে তার দৃষ্টি উপরের দিকে। মাথার উপর কেবল বৃহৎ বিটপীর অবারিত রাজ্যত্ব। সূর্যালোকও সমীহ করে যত কিঞ্চিৎ পাতার ফাঁক গলে নিচে আসার অনুমোদন পায়। আমার দৃষ্টিতে গাছের পল্লব ভিন্ন অন্য কিছু ধরা দেয় না। ভাবি কোন পাখি বা প্রাণী হবে হয়তো।
বহু বছর আগের স্মৃতিকে জাগিয়ে দিয়ে হাতে ধরা দেয় সে। অতীতে কেবল পাকা রূপটিই দেখেছি। কাঙই উচ্চারণ করে ‘ঐপাচুয়ই’। মাটির দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখি ঝিরির জলে নুড়ি পাথরের ফাঁকে হাল্কা সবুজ একটি ফল। প্রথম দেখায় জলপাইয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা আছে। হাতে নিয়ে জানতে পারি এটি ‘রক্তগোলা’। আমার ত্রিপুরা বন্ধুটি ততক্ষেণে বড় একটি গাছে পেঁচিয়ে থাকা লতা ধরে তরতর করে উপরে থেকে উপরে উঠে চলেছে। আমি ভাবলাম এই গাছটিই হবে হয়তো। না; কাঙই দেখিয়ে দিলেন গাছটির গাত্র জড়িয়ে মোটা যে লতাটা ভালবাসায় মাখামাখি করে সমস্ত গাছ জুড়ে মিলেমিশে একাকার – সেই ‘রক্তগোলা’। গোটা পাঁচেক হাতে নিয়ে অতীত স্মৃতির সাথে মিলাতে চেষ্টা করলাম। মিল খুঁজে পেলাম না। কাঁচা এই ফলটি পাকার পর ভিন্ন রঙ ধারণ করে। আমি অতীতে পাকা ফলই দেখেছিলাম।
পাকা ফল গাড় লাল বা খয়েরি। হাতের তলায় হাল্কা চাপে ফাটিয়ে নিতেই সে পুরনো স্মৃতির সাথে সুর মিলিয়ে বলে উঠে, এই না- হলে ‘রক্তগোলা’। সমস্ত হাত গাঢ় লাল রঙে রঙিন। সত্যিই মনে হবে রক্ত ঝরছে। যাক রক্তগোলার জন্যই বিশ্রামের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। ত্রিপুরা বন্ধুটি গাছ থেকে এক থোকা অর্ধপাকা ফল নিয়ে নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে এর স্বাদ নেয়া হয়ে গেছে। পাকা ফলের স্বাদ কিছুটা মিষ্টি। কাঁচা অবস্থায় টক। ঝিরির হাল্কা জলে পা ভিজিয়ে গল্পের পাখা মেলতে শুরু করেছে। নানা গল্পের ফাঁকে ত্রিপুরা বন্ধুটি রক্তগোলা নিয়ে রূপকথার গল্প শুনিয়ে চলে…
অনেক অনেক দিন আগের কথা। প্রাচীন কালে উচুঁ পাহাড় ঘেরা এক রাজ্য ছিল। সেখানে ছিলেন এক রাজা। তাঁর ছিল এক অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা। রাজকন্যা যেমন সুন্দরী তেমনি তাঁর সুরেলা কন্ঠ। রাজকুমারীর এই গুণের কথা আশপাশের সকল রাজ্যের মানুষের কাছে ছড়িয়ে পরে। তারাও রাজকুমারীর গান শুনার জন্য ব্যাকুল ছিল। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই তো আর রাজকুমারীর গান শোনা যায় না। রাজকুমারী ছিলেন লাজুক ও অভিমানী। পাহাড়ের উপরে ছোট্ট এক হ্রদের পাশেই ছিল তাঁর ঘর। যেখানে রাজকুমারী মনের সুখে গান গেয়ে বেড়াতেন। সেই গান আশপাশের প্রাণী ও পাখিরাও অবাক হয়ে শুনতো। কিন্তু কোন মানুষের পক্ষে সেই গান শোনা ছিল কল্পনার অতীত।
কেবল রাজকুমারীর যাকে ইচ্ছে হতো তাকেই গান শুনাতো। পাশের রাজ্যের এক রাজকুমার রাজকন্যার কথা জেনে তাঁর গান শুনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। একদিন লোক লস্কর নিয়ে পাহাড়ি সেই রাজ্যে রাজকুমার এসে হাজির। তার ইচ্ছার কথা জানায়। আড়াল থেকে রাজকুমারীও রাজকুমারকে দেখে পছন্দ হয়। রাজকুমারকে বলে, “তুমি যদি আমাকে তোমাদের রাজ্যে নিয়ে যাও তবেই আমি গান শুনাবো।” রাজকুমার তো এ কথা শুনে আত্মহারা। তবে শর্ত হলো, রাজকুমারীকে যেহেতু আজ পর্যন্ত পরিবারের বাহিরে কেউ দেখে নাই তাই রাজকন্যাকে নিয়ে যেতে হলে সেই ব্যবস্থাই করতে হবে রাজকুমারকে। শর্ত শুনে রাজকুমার তাঁর সাথের সব লোকজনকে পাঠিয়ে দিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে তারা রাজকুমারের রাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। রাজকুমারী দুধ সাদা পোষাকে সজ্জিত হয়ে মুখ ঢেকে রাখে। তারা দু’জনেই রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে পা বাড়ায়। পথ চলতে চলতে ক্লান্ত রাজকুমারী বিশ্রামের জন্য দাঁড়ায়। সুন্দর দেখে একটি ঝিরির পাশে রাজকুমারী বসে পড়েন। রাজকুমারী যে জায়গায় বসেন তার নিচেই ছিল কিছু ফল। সেই ফলগুলো থেকে রক্তের মত লাল রঙ লেগে যায় রাজকুমারী গায়ে। রাজকুমার ভাবে রাজকুমারীর হয়তো ঋতুকাল চলছে। তাই সে হাসে আর বলে, “রাজকুমারী কোন সমস্যা নেই, মহিলাদের গর্ভবতী হবার বয়স হলে এরকম হয়।” রাজকুমারী এতে বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। রাজকুমারী অভিষাপ দেয়ে সেই ফল গাছকে যে তাকে লজ্জায় ফেলেছে, “তুমি সারা জীবন ঝোপ-ঝাড় আর ঝিরি কাছেই থাকবে তুমি কখনই বড় গাছ হয়ে উঠতে পারবে না ”। আর এ দিকে রাজকুমারের হাসি আর থামেনা। রাজকুমারী রাগে ক্ষোভে প্রকান্ড গাছের রূপ নেয় আর বলে, “ রাজকুমার তুমি আমার অবস্থা দেখে হাসলে তাই তোমার আমার মিলন এ জনমে হবে না”।
রাজকুমারী রূপ পাল্টাতে পাল্টাতে ধীরে ধীরে প্রকান্ড বৃক্ষে পরিণত হয়। এদিকে রাজকুমারও মনের কষ্টে ‘রক্তগোলা’ লাতায় রূপ নেয়। আর সেই গাছকে জড়িয়ে নিজের বুকে রক্তের ধারা লুকিয়ে রাখে।
ত্রিপুরা ভাষায় রক্তগোলাকে বলে ‘থাইচাও’। ফলটি আমাদের পাহাড়ের নিজস্ব একটি ফল। আমাদের দেশ ছাড়াও ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পাহাড়ি এলাকায় ফলটি দেখা যায়। স্থানীয় বাঙালিরা একে লালগোলা, চাকমারা বলে রসকো আর মার্মারা বলেন রাঙচুই। ভারতে ফলটি খুনফল নামে পরিচিত।
আমাদের গল্পের আসর যেন শেষ হতেই চায় না। এদিকে সময় যাচ্ছে গড়িয়ে। তবু, আমি কাঙইকে বলি, দাদা আপনার জানা এরকম কোন গল্প নেই? প্রথমে মাথা নেড়ে না জানায়। তারপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে বলতে শুরু করে…
আদি যুগে পাহাড়ে একটি গ্রাম ছিল। সে গ্রামের মানুষ শিকার করতো আর পশু পালন করতো। গ্রামের যুবকরাই শিকারে যেতো। একবার কিছু যুবক শিকারের জন্য গভীর জঙ্গলে যায়। দিন যায়, রাত যায় তারা আর ফিরে আসে না। এভাবে তিন রাত তিন দিন চলে যাবার পর গ্রামের এক বৃদ্ধ বলে, তাদের খুঁজতে যেতে হবে। গ্রামের অন্যরা সবাই সেই যুবকদের খোঁজ করতে বেরিয়ে পরে। অনেক খোঁজেও তাদের আর দেখা পায় না। তারপরও খোঁজ চলতে থাকে। একদিন পাহাড়ের এক গুহার সামনে কিছু হাড় দেখতে পায় আর একটি বাঁশি পরে থাকতে দেখে তারা বুঝতে পারে তাদের যুবকরা কেউ আর বেঁচে নেই। কিন্তু কি হল তাদের? অনুসন্ধান করে জানতে পারে অতিকায় এক সাপ তাদের খেয়ে ফেলেছে। এতে গ্রামের মানুষেরা ভয় পেয়ে যায়। তারপরও কাজের জন্য তো পাহাড়ে যেতেই হয়। কিছুদিন পর আরও কিছু যুবক হারিয়ে যায়। সবাই বুঝতে পারে এটি সেই সাপেরই কাজ।
এ থেকে রেহাই পাবার জন্য তারা জ্ঞানী ব্যাঙ এর কাছে যায়। জ্ঞানী ব্যাঙ তাদের বুদ্ধি দেয়। গুহার চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে দাও। কথামতো গ্রামের সবাই প্রস্তুত হয়ে সেই গুহার কাছে যায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। পাথর ছুড়ে সাপটিকে আঘাত করতে থাকে। সাপটি বাঁচার জন্য গুহা ছেড়ে পালিয়ে যায়। গ্রামবাসী সেই সাপের পিছু নেয়। আজ তারা কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। সাপটি পালাতে পালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আর পারে না। এমন সময় সাপটির সেই জ্ঞানী ব্যাঙ এর কথা মনে পড়ে। সে তার কাছে সাহায্য চায় আর বলে, সে আর কোনদিন গ্রামের যুবকদের হত্যা করবে না। জ্ঞানী ব্যাঙ তখন বলে, “সাপের রূপে থাকলে তোমাকে বাঁচানো যাবে না। তুমি গাছের রূপ ধারণ কর”। সাপটির বুক হতে তখনও রক্ত ঝরছিল। জ্ঞানী ব্যাঙ সাপটিকে একটি লতা গাছে রূপান্তরিত করে। আর তার রক্তের ফোটাগুলো ফল হয়ে যায়। গ্রামবাসী এসে দেখে সাপ নেই। ব্যাঙ রাজা বলে, সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে, তোমরা তাকে ক্ষমা করে দাও। সে সারা জীবন বুকের মধ্যে রক্তের ধারা নিয়ে বেঁচে থাকবে।” সাপটি যে লতা গাছের রূপ নেয় সেই গাছটিই ‘ঐপাচুয়ই’।
গল্প এখানেই শেষ হয়ে যায়। তারপর একটা হাসি। আর সরল উত্তর, “দাদা এটা গল্প আরকি! সত্যি কিছু নাই”। আমরাও কাঙইয়ের সাথে হাসি।
রক্তগোলা বহুবর্ষজীবী পরাশ্রয়ী লতানো উদ্ভিদ। সাধারণত ঝিরির আশপাশে শুকনো জায়গায় জন্মে। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এর সিজন। কাঁচা অবস্থায় এর রঙ হাল্কা সবুজ। পাকা অবস্থায় গাঢ় লাল বা খয়েরি। খাদ্য ও ঔষধিগুণ সম্পন্ন। ম্রোরা কাঁচা রক্তগোলা রান্না করে খায়। ফলটি নিয়ে এক দশক আগে গবেষণা শুরু করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। স্থানীয় লোকজন এর শিকড় ও বিচি ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করেন। জন্ডিস রোগের চিকিৎসায় এর ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও রক্তস্বপ্লতা ও চুলকানিতেও রক্তগোলার ব্যবহার করেন স্থানীয় জনগোষ্ঠী। এ ফলটি থেকে চমৎকার ফুড কালার ও জেলি, জ্যাম তৈরি কারা যেতে পারে।
আমরা শরীর থেকে গল্পের গন্ধ ঝেড়ে ফেলে তা হৃদয়ে ধারণ করে উঠে দাঁড়াই। এবার সামনের দিকে যেতে হবে। হঠাৎ দেখি আমার সঙ্গীর প্যান্টের পকেটের কাছে লাল রঙ। বেশ অনেকটা রঙ। আমি বলতেই ও বলল, “পকেটে অনেকগুলো রক্তগোলা আছে, হয়তো কোনটা ফেটে লাল রঙ বের হয়েছে।” আমিও তাই ভাবলাম। পথ চলতে থাকি আমরা। অল্প কিছু দূর যাবার পর আমার মনে পরে! আমি পিছন থেকে আমার বন্ধুটিকে দাঁড়াতে বলি আর তার প্যান্টের ভিতরটা ভালভাবে দেখতে বলি। ব্যস, যা সন্দেহ করে ছিলাম তাই। তিনি সুবিধাজনক জায়গা পেয়ে ইচ্ছা মতো রক্ত চুষে ঢোল হয়ে ফেটে গেছেন। ঐ লাল রঙ রক্তগোলার নয় ওটা জোকে খাওয়া রক্ত । আমরা সবাই নির্বাক, শুধু ওর মুখেই শোনা গেল, ঐপাচুয়ই : পাহাড়ের বুকে শোণীত ধারা।
ছবি : লেখক